নীল দর্পণ নাটকের নামকরণের সার্থকতা বিচার কর। 2221005

নীল দর্পণ

নীল দর্পণ নাটকের নামকরণের সার্থকতা বিচার কর।

বাংলা সাহিত্যে নাটক একটি বিশেষ প্রকরণ। দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-১৮৭৩) রচিত নীল দর্পণ (১৮৬০) বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম নাটকের কাহিনি, ঘটনা, আঙ্গিক পরিকল্পনা, গঠনবিন্যাস-এসব বিচারে ‘নীল দর্পণ’ একটি সফল নাটক। ‘নীল দর্পণ’ নাটকটির নামকরণের বেশ রয়েছে। ঘটনা নয়, চরিত্র নয়, নাট্যকারের বিশিষ্ট চিন্তার প্রকাশ ‘নীল দর্পণ’ নাটকের নামকরণের মধ্যে লুকায়িত রয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে নিম্নে নীল দর্পণ নাটকের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা করা হলো-

নীল দর্পণ নাটক

বাংলা নাট্যসাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্রের  নীল দর্পণ নাটক বাংলাদেশে নীলচাষ, নীলকরদের অত্যাচার, এবং অংশত নীল আন্দোলনের দর্পণ। নাটকের কাহিনিসূত্রে দেখা যায় যে, এ নাটকে সংঘাত হয়েছে, তা মানুষে মানুষে। দুটি অসম শক্তি এ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। একদিকে নীলকর, অন্যদিকে কৃষক প্রজাবৃন্দ, এক কথায় নীলচাষীরা। এ নীলচাষীদের মধ্যে রয়েছে গোলক বসু, নবীনমাধব, বিন্দুমাধব, তোরাপ, সাধুচরণ, রায়চরণ ইত্যাদি। এ নাটকে ছোট-বড়, নারী-পুরুষ মিলিয়ে বেশ কিছু চরিত্রের উপস্থিতি দেখা যায়। সব চরিত্রই কম-বেশি নীলকরদের অত্যাচারে জর্জরিত এবং এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে তারা সংগ্রামশীল। ‘নীল দর্পণ’ নাটকের তৎকালীন সময়ের পেক্ষাপটে দেখা যায় যে, ঐ সময়ে নীল লাভজনক প্রধান রপ্তানি দ্রব্য ছিল। তাই বৃটিশরা সারা বাংলায় নীলকুঠি স্থাপন করে। তারা কৃষকদেরকে নীলচাষে বাধ্য করে। অথচ চাষীদেরকে উপযুক্ত মূল্য থেকে বঞ্চিত করে । কেউ নীলচাষ করতে অস্বীকার করলে তাকে জোরপূর্বক ধরে এনে নীলকুঠিতে নানা রকম শারীরিক নির্যাতন করা হতো। গরু-বাছুর, সহায় সম্পত্তি লুট করতো। বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিতো। আবার কখনো কখনো সুন্দরী যুবতী কন্য-স্ত্রীদের জোরপূর্বক ভোগ করতো। নাটকের কাহিনিতে দেখা যায়, স্বরপুর গ্রামের বাসিন্দা গোলকবসু পরিবার এ রকম অত্যাচারের শীকার। এই স্বরপুর গ্রামের কৃষক পরিবারের অত্যাচারের ঘটনা নিয়ে ‘নীল দর্পণ’ নাটকটি রচিত হয়েছে।

 

স্বরপুর গ্রামের বাসিন্দা গোলকবসু স্বচ্ছল-সুখী পরিবার। তাদের সংসারে কোন অভাব-অনটন ছিল না। কিন্তু নীলকরদের থাবায় বসু পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। গতসনে গোলকবসু পঞ্চাশ বিঘা জমিতে নীল চাষ করেছে, কিন্তু একটি পয়সাও পায়নি। এবার আবার ষাট বিঘা জমিতে নীলচাষের জন্য বাধ্য করা হচ্ছে। নীলকরেরা জোরপূর্বক গোলকবসুর পুকুরপাড় পর্যন্ত নীলের চাষ সম্প্রসারণ করতে চায়। এতে নবীনমাধব বাধা দেয়। নবীনমাধবের ভেতরে নায়কের কিছুটা গুণ আছে, তবে শেষ পর্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারেনি। ‘নীল দর্পণ’ নাটকের কাহিনি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তার ছিল না। তবে নীলকরদের অত্যারের বিরুদ্ধে নায়োকচিত ভূমিকা পালন করতে সে সচেষ্ট ছিল। সাহেবের বুকে সজোরে আঘাত করে। ফলে নবীনমাধবের উপর নির্মম অত্যাচার শুরু হয়। অবশেষে নবীনমাধব মৃত্যুও মুখে ঢলে পড়ে। ছেলের মৃত্যুও খবর শুনে মা পাগল হয়ে যায় এবং উন্মাদ অবস্থায় পুত্রবধূকে হত্যা করে। পরে জ্ঞান ফিরে এলে অনুশোচনা করে এবং নিজেও আত্মহত্যা করে। অন্য দিকেগোলকবসুর উপর মিথ্যা ফৌজদারি মামলা দেওয়া হয় এবং তাকে বন্দী করে হাজতে রাখা হয়। ক্ষোভে-দুঃখে গোলকবসু আত্মহত্যা করে। এভাবে বসু পরিবারটি নীলকরদের অত্যাচারে তছনছ হয়ে যায়। অন্যদিকে নারী চরিত্রের মধ্যে ক্ষেত্রমনি কিছুটা উজ্জ্বল। গোলকবসুর প্রতিবেশী সাধুচরণের কন্যা প্রথম অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বাবার বাড়িতে এসেছে। নীলকরদের চোখ পড়ে এই ক্ষেত্রমনির উপর। তারা লোক লাগিয়ে জোরপূর্বক ক্ষেত্রমনিকে নীলকুঠিতে তুলে নিয়ে যায় এবং ধর্ষণ করার চেষ্টা করে। এই অত্যাচারে শেষ পর্যন্ত ক্ষেত্রমনিও মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। আত্মরক্ষার সংগ্রামে সে কিছুটা সাহসের পরিচয় দেখালেও তা যৎসামান্য। শেষ পর্যন্ত নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি।

চরিত্রের দিক দিয়েই হোক, আর ঘটনা বিন্যাসের দিক দিয়েই হোক; ‘নীল দর্পণ’ নাটকের নামকরণ যথার্থ হয়েছে। নাট্যকারের একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সিদ্ধির কারণে ‘নীল দর্পণ’ নাটকে অনেক মৃত্যু সংঘটিত হয়েছে। নাটকটি রচনার পিছনে নাট্যকারের প্রধান উদ্দেশ্য বিদেশি নীলকরদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা। তাই তিনি এ নাটকে নীলকরদের অত্যাচার, কৃষক সমাজের দুঃখ-দুর্দশা কয়েকটি শোকাবহ মৃত্যুর দৃশ্যকে যে সুষ্পষ্টরেখায় চিহ্নিত করেছেন, তা সবই নীলকরদের অত্যাচারকে ঘিরে। দর্পণে যেমন আমরা হুবহু ছবি দেখতে পাই, তেমনই এ নাটকে নীলকরদের অত্যাচার ও কৃষকের বিদ্রোহের ছবি স্পষ্ট দেখতে পাই। এ নাটকের কম-বেশি সব চরিত্রই নীলকরদের অত্যাচারে জর্জরিত। উনিশশতকের নীলচাষের সার্বিক চালচিত্র এ নাটকে ফুটে উঠেছে। তাই এ নাটকটির নামকরণ ‘নীল দর্পণ’ সার্থক সর্বোতভাবে সার্থক হয়েছে।

উপর্যুক্ত বিষয়ের পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, দীনবন্ধু মিত্র রচিত ‘নীল দর্পণ’ নাটকে প্রতিটি চরিত্রই কোন না কোনভাবে নীলকরদের অত্যাচারে ও নীলচাষের শিকার। এমনকি নারী চরিত্রগুলোও এ অত্যাচার থেকে মুক্তি পায়নি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মতো কোন সামর্থ তাদের না থাকায় তারা প্রায়ই নীরব প্রতিবাদ জানিয়েছে; আবার কখনো কখনো সরব হয়েছে। তাই সার্বিক বিচার বিশ্লেষণে বলা যায় যে, ‘নীল দর্পণ’ নাটকের নামকরণ সবদিক থেকে সফল হয়েছে।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *