বাংলাদেশের নৃত্যের ধারা সম্পর্কে একটি নিবন্ধ রচনা কর। 211003

বাংলাদেশের নৃত্যের ধারা
বাংলাদেশের নৃত্যের ধারা সম্পর্কে একটি নিবন্ধ রচনা কর।

নাচের মাধ্যমে মানুষের বিভিন্ন অনুভূতির প্রকাশ ঘটে। এর মূল লক্ষ মানুষের কোমল প্রবৃত্তিকে জাগ্রত করা, সুন্দর জীবন গঠনের প্রেরণাকে জোগানো এবং একই সাথে নির্মল আনন্দ দেওয়া। বাংলায় প্রাচীনকাল থেকেই নাচ প্রচলিত ছিল। সময়ের সাথে বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে মিলিত হয়ে বাংলার নাচে অনেক বৈচিত্র্য এসেছে। বর্তমানে বিশ্বায়নের প্রভাবে এ দেশের নাচে নতুন নতুন ধারা সংযুক্ত হয়েছে। নিম্নে বাংলায় নৃত্যের ধারা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

নাচের একাল-সেকাল : প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে উচ্চাঙ্গ নৃত্যের উলে−খ আছে। মধ্যযুগে চৈতন্যদেব তাঁর শিষ্যদের নিয়ে সংকীর্তন চালু করেছিলেন। কীর্তনে ভক্তরা মৃদঙ্গ-মন্দিরা বাজিয়ে কৃষ্ণের জয়গান করতো এবং গোল হয়ে নাচত। মুঘল আমলে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে নাচের প্রসার ঘটে। এ সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নতুন নতুন নাচ, ছন্দ, লয়, তাল ইত্যাদির সৃষ্টি করা হয়। এরপর ইংরেজ আমলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে নাচের রূপ অনেক বদলে যায়। সমাজের ধনী লোকেরা তখন মনোরঞ্জনের জন্য নাচকে তাদের জলসাঘরে স্থান দেয়। ফলে নৃত্যকলা সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যম থেকে শুধু ধনীদের মনোরঞ্জনের বিষয়ে পরিণত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে নৃত্যকলা ক্রমেই জীবনমুখী হয় এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় প্রসার লাভ করতে থাকে।

উচ্চাঙ্গনৃত্য : প্রাচীন ভারতে বৈদিক ধর্মকে কেন্দ্র করে যে নৃত্যকলা শুরু হয়েছিল তাই উচ্চাঙ্গনৃত্য নামে পরিচিত। এ নৃত্য পৌরাণিক কাহিনি নির্ভর। তাই স্বাভাবিকভাবে তাতে দেবদেবীর প্রতি ভক্তিভাব লক্ষ করা যায়। প্রাচীনকালে মন্দিরের ভেতরে সেবাদাসীরাই কেবল এ নাচ পরিবেশন করতো। ধীরে ধীরে উচ্চাঙ্গনৃত্যকলা মন্দিরের গণ্ডি পেরিয়ে একটি শিল্প হিসেবে বিকাশ লাভ করে। উচ্চাঙ্গনৃত্য চারপ্রকারের। কথাকলি, ভরতনাট্যম, কথক ও মনিপুরি। নৃত্যের ধারা

লোকনৃত্য : মানুষের জীবনধারা, জন্ম-মৃত্যু, প্রেম-বিরহ, ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে লোকনৃত্যের উদ্ভব হয়েছে। এ নৃত্যের কোন লিখিত রূপ নেই। মানুষের সাংস্কৃতির রীতি-নীতির স্বাভাবিক নিয়মে লোকনৃত্য এসেছে। বাংলাদেশের প্রচলিত লোকনৃত্যের মধ্যে রয়েছে আনুষ্ঠানিক নৃত্য, আঞ্চলিক নৃত্য, ঋতুবিষয়ক নৃত্য, বীর বা যুদ্ধবিষয়ক নৃত্য ও কাহিনিমূলক নৃত্য। এসব নাচের সময় দেশিয় ঢোল, ঢাক, বাঁশি, খোল, করতাল ব্যবহৃত হতো।

জাারি নাচ : জারি নাচ বাংলাদেশের একটি সুপরিচিত লোকনৃত্য। ময়মনসিংহ অঞ্চল এ নাচের জন্য খ্যাত। এর বিষয়বস্তু কারবালার যুদ্ধবৃতান্ত। এ নাচে একজন গায়কের নেতৃত্বে ২৫ থেকে ৩০ জন পায়ে ঘুঙুর ও হাতে রুমাল বেঁধে জারি গান ও নাচে অংশ নেয়।

গম্ভীরা : বাংলাদেশের জনপ্রিয় লোকসংগীত হলো গম্ভীরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, রাজশাহী, পাবনা অঞ্চলে গম্ভীরা গানের প্রচলন আছে। গম্ভীরা গানে দ’ুজন গায়ক থাকে। তারা গানের সাথে নাচ পরিবেশন করে। দ’ুজনের মাথায় বাঁশের তৈরি টুপি এবং মূল গায়কের হাতে কঞ্চির লাঠি থাকে। দুই হাতে লাঠি ধরে গান পরিবেশনের পাশাপাশি তিনি কোমর দুলিয়ে নাচেন। পাশের জনও একই ভেঙ্গিতে নাচেন। বর্তমানে সামাজিক সচেতনতার বিষয় নিয়ে এ গান ও নাচের আয়োজন করা হয়।

খেমটা নাচ : খেমটা বাংলাদেশের প্রাচীন লোকনৃত্য। রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে কেন্দ্র করে এ নাচ পরিবেশিত হয়। এক সময় গ্রামের বিয়ের আসরে এ নাচ পরিবেশন করা হতো। খেমটা নাচের সাথে জড়িত নারীদের ‘নাচনী’ বলা হয়। নাচনীদের নাচের সাথে গায়কেরা গান পরিবেশন করে।

আধুনিক নৃত্য : সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল। সময়ের সাথে সাথে সংস্কৃতির যেমন পরিবর্তন ঘটে, তেমনই পরিবর্তন ঘটে নৃত্যশিল্পের। নৃত্যশিল্পের এ পরিবর্তনের ধারায় একটি নতুন রূপ হলো আধুনিক নৃত্য। দেশিয় ও পাশ্চাত্য রীতির সংমিশ্রণে আধুনিক নাচ পরিবেশিত হয়। দেশি-বিদেশি সিনেমা, ভিডিও ইত্যাাদির প্রভাবে আধুনিক নৃত্যের প্রসার ঘটেছে। তবে এ ধরণের নাচ বর্তমানে বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

আদিবাসীনৃত্য : বাংলাদেশের আদিবাসীদের জীবনযাত্রার একািট আকর্ষনীয় দিক হলো তাদের নাচ। প্রায় প্রতিটি জাতি ও গোষ্ঠীর রয়েছে তাদের নিজস্ব নাচ ও গান। ধর্মীয় ও সামাাজিক নানা উৎসবকে কেন্দ্র করে এসব নাচ ও গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের উভাগীত ও জুমনৃত্য, মারমাদের প্রদীপ ও থালা নৃত্য, ত্রিপুরাদের গরাইয়া ও বোতলনৃত্য, লুসাই ও বোমদের পুষ্প ও বাঁশনৃত্য, কক্রবাজারের রাখাইনদের ছাতানৃত্য খুবই চমৎকার। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, বাদ্যযন্ত্র ও গানের সাথে তারা কখনো একত্রে, আবার কখনো এককভাবে নাচে। মুৃনিপুরিদের বিভিন্ন নাচ এখন পৃথিবীর অনেক দেশে জনপ্রিয়।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুর ।

 

About সালেক শিবলু

বিএ অনার্স, এমএ (প্রথম শ্রেণি) এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

View all posts by সালেক শিবলু