বিশেষত্ব প্রোথিত থাকলেও বাউল গানগুলো শিল্পগুণে সমৃদ্ধ’-এ উক্তির সত্যাসত্য যাচাই করো।

বিশেষত্ব প্রোথিত থাকলেও বাউলের বাউল গানগুলো শিল্পগুণে সমৃদ্ধ’-এ উক্তির সত্যাসত্য যাচাই করো।

বাংলা লোকসাহিত্যের সমৃদ্ধ সম্পদ বাউলগান । ভাবুকজনের রচিত এসব গানে ভাব, ভাষা, ছন্দ ও অলংকারের সচেতন শিল্প পরিমার্জনা নেই বটে, তবে এর নিরাভরণ ভাবানুভূতির মধ্যেই ঝুঁকি মারে শৈল্পিক সৌন্দর্য । একটি বিশেষ ধর্ম এবং সেই ধর্মসাধনার তত্ত্ব বাউল গানে প্রোথিত হলেও নিজের কবিদের কবিত্বশক্তি এবং প্রজ্ঞার স্বতঃস্ফূর্ত প্রণোদনায় গানগুলো সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে । বাউলতত্ত্বের গঢ় রহস্য শব্দের বৈচিত্র্য ও অলংকার পরিপাট্যে ব্যঞ্জনা-মধুর হয়ে উঠেছে । বাংলার লোকায়ত বিশ্বাসের অন্যতম রূপমূর্তি বাউল দর্শনের মধ্যে প্রাণ পেয়েছে। বাউল সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, জগৎ-জীবন সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা বাউল গানে স্থান পেয়েছে । ভাবের সহজ প্রকাশ বাউল দর্শনের মধ্যে প্রাণ পেয়েছে । বাউল সম্প্রসারের বিশ্বাস , অধ্যাত্মবোধ বাউল গানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য । গুরু মনের মানুষ, ভগবান , ইত্যাদি সম্পর্কিত ভাবনা শৈল্পিক রসে সিক্ত হয়ে গানগুলোতে রূপ লাভ করেছে । গুরু সম্পর্কিত ভাবনার প্রকাশে লোককবির উচ্চারণ- আমার দেহ জমি আবাদ হইল না/শুরুর বীজ বুনতে পারলাম না । মনের মানুষের সাধনা বাউলতত্ত্বের বিশেষ দিক । মনের মানুষ তথা পরমাত্মার সন্ধানে বাউলরা সদা তৎপর । তাঁদের পরমাত্মা সম্পর্কিত ভাবনার প্রকাশে রয়েছে শিল্পের ছাপ । ভাবে বিভোর হয়ে তাঁরা উচ্চারণ করেছেন-

আমি একদিনও না দেখিলাম তারে
আমার বাড়ির কাছে আরশী নগর,
……এক পরশী বসত করে ।

বাউলের কাছে জাতি, ধর্ম, বর্ণের ভেদাচ্ছেদ নেই । তাঁদের এ মনের ভাবের প্রকাশ আছে বাউল গানে । এই ভাব প্রকাশ করা হয়েছে শিল্পরসে পূর্ণ করে । ভগবান ভক্তির জোরেই ভক্তের কাছে ধরা দেয় , তাঁর কাছে কোন জাতিভেদ নেই । বাউল লালন শাহ বলেছেন-

ভক্তির দ্বারে বাঁধা আছে সাঁই
হিন্দু কি মন বলে তার
কাছে জাতের বিচার নাই ।

তত্ত্বকথা প্রকাশ করতে বাউলরা দৈনন্দিন জীবন থেকেই উপাদান নিয়ে শিল্পসম্মত ভাবে উপস্থাপন করেছেন-

অনুরাগে গাছ কাটলেই কি গাছি হওয়া যায়
ও যে ঘোলা রসে বীজ মরে না,
ধর্ম-মাছ ধরব বলে নামলাম জলে
ভক্তি হাল ছিঁড়ে গেল ।

ভাবকে প্রকাশ করতে বাউলের ভাষা যেমন বিষয়োাপযোগী করেছেন, তেমনি শব্দ ব্যবহারও করেছেন বৈচিত্র্যপূর্ণ ভাবে । আরবি, ফারসি, তৎ্সম, তদ্ভব শব্দের ব্যবহার বাউল গানগুলো চমৎকারিত্ব লাভ করেছে । এছাড়া শব্দ ব্যবহারে হিন্দু – মুসলিম ঐতিহ্যের অসাধারণ সমন্বয় রক্ষিত হয় । রাম, গঙ্গা, হনুমান, হরি, বেদ- বেদাস্ত , শশ্মাশান যেমন আছে, তেমনি আছে আসমান, সাঁই, তসবি, সুন্নত, মোকাম , বেবদাতি প্রভৃতি শব্দ । আরও বিচিত্রœ শব্দের দৃষ্টান্ত তৎসম হস্ত, পদ, স্কন্ধ, নীর । লোকজ জেলে , গাজি , পড়া , গুগলি, ঘোঙা ইত্যাদি । আরবি: লাহুত, মালকুত, নাসুভ প্রভৃতি ।

বাউল গানগুলোতে শব্দ ব্যবহারে যেমন বৈচিত্রা আছে, তেমনি অলংকার প্রয়োগেও লোককবিদের নৈপুণ্য লক্ষণীয় উপমা, রূপক, অনুপ্রাস প্রততি অলংকারের ব্যবহরে বাউল গানগুলো শিল্পগুণে ভরপুর হয়ে উঠেছে ।

উপমা           :    ও সে স্বীকাল মাছের মত
প্যাকের মধ্যে ফাঁক পেয়েছে ।
রূপক           :     আমার দেহ জমি আবাদ হইল না
গুরুর বীজ বুনতে পারলাম না ।
অনুপ্রাস        :     পরম গুরু প্রেম – পীরিতি
কাম – গুরু হয় নিজ পতি ।

ছন্দ ও রসের ক্ষেত্রেও বাউল গানগুলো সার্থকতা লাভ করেছে । বাউলরা প্রধানত মনের মানুষকে পাওয়ার জন্য সাধনা করে । তাই পাওয়া না পাওয়ার বেদনায় বাউল গান বেদনা তথা করুণ রসে সিক্ত । এ ছন্দ অধিকাংশই মিল প্রধান মাত্রাবৃত্ত ছন্দ । যেমন-

বলব কি সে প্রেমের কথা
কাম হইল সে প্রেমের লতা,
কাম ছাড়া প্রেম যথা তথা
নাইরে আগমন।

বাউল গান সহজ-সরল প্রাণের সহজ- সরল অভিব্যক্তি । এ গানের সংগীত মাধুর্য ও কাব্যধর্মিতা অসাধারণ বাউল গানের বহুপঙক্তি শিল্প গুণসম্পন্ন । ‘আমি একদিনও না দেখিলাম তারে’‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি / পাখি কেমনে আসে যায়’ । ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে / আমরা ভেবে ভেবে করবো কি ।’’ এসব পঙক্তি সাহিত্যরসে সিক্ত এবং শিল্পগুণে সৌন্দর্যম-িত ।

পরিশেষে বলা যায়, তত্ত্ব ভারাক্রান্ত হলেও বাউল গান গুলো শিল্পগুণে সমৃদ্ধ । আবেগ মাধুর্য , প্রকাশভঙ্গীর সারল্য শব্দের ব্যবহার বৈচিত্র্য এবং অলংকার নৈপূণ্যে এ গান অনন্য । কাব্যিক মাধুর্য এবং শিল্পরসে সমৃদ্ধ । বিদগ্ধজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে । স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাউলগানের কাব্যিক মাধুর্য এবং তত্ত্বের গাম্ভীরে মুগ্ধ হয়ে ছিলেন । তত্ত্বকথা থাকলেও লোককবিদের সহজ – সরল জীবনানুভূতির ব্যঞ্জনাময় প্রকাশে বাউল গানগুলো শিল্প-গুণসম্পন্ন হয়ে উঠেছে ।

সালেক শিবলু. এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

Scroll to Top