শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা আর বৈষ্ণবপদাবলির রাধার তুলনামূলক আলোচনা কর। 221003

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা আর বৈষ্ণবপদাবলির রাধার তুলনামূলক আলোচনা কর।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রাধা চরিত্র প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম। একটি পূর্ণাঙ্গ নারীচরিত্র অঙ্কন এবং তার প্রেমচেতনার প্রত্যেকটি স্তরে নিপুণ আলোকসম্পাতনে বড়ু চণ্ডীদাস যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন তা বিস্ময়কর। আবার একই রাধাকে নিয়ে বৈষ্ণব কবিরাও নানা পদ রচনা করেছেন। এই দুই রাধা একই নারী হলেও তার প্রেমের প্রকৃতি ভিন্ন। নিম্নে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এর রাধা ও বৈষ্ণবপদাবলির রাধার তুলনামূলক আলোচনা লিপিবদ্ধ করা হলো-

প্রথমে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধার চরিত্র আলোচনা করতে চাই। রাধা চরিত্রের প্রথম পর্যায়ে কৃষ্ণের প্রতি তার প্রবল বিরূপতা ও বিতৃষ্ণার ভাব লক্ষ্য করা হয়। রাধা কৃষ্ণের প্রেরিত প্রেম-উপহার ফুল-তাম্বুল পদদলিত করেছে। এগারো বছরের বালিকা রাধা স্বামী – সংসার ও সমাজের অনুশাসনে চালিত হয়েছে, দানখণ্ডে কৃষ্ণ পথের মধ্যে দানী সাজিয়ে রাধার দেহের প্রতি অঙ্গের জন্য দান চেয়ে বসে। রাধা কৃষ্ণের এমন অন্যায় আবদারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে। এরপর সে মামী – ভাগিনার সম্পর্কের কথা স্বরণ করিয়েও কৃষ্ণকে ক্ষান্ত করতে পারে নি। একসময় কৃষ্ণের আকাঙ্খার নিকট রাধাকে আত্মসমর্পন করতে হয়। কৃষ্ণকে দেহদান করে রাধা অপমানে ক্ষোভে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু নৌকা খণ্ডে রাধার কিছুটা মানসিক পরিবর্তন ঘটে। দানখণ্ডে সে বলেছিল দেখ হার যেন না ছেড়ে, মাথার মুকুট যেন না ভাঙে, দেহে যেন আঘাত না পাই। কিন্তু নৌকাখণ্ডে কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনে রাধার মনে ভয় ও লজ্জার সমাবেশ হয়েছে। দানখণ্ডে কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনে রাধা নিজেকে অপমানিত বোধ করলেও নৌকাখণ্ডে দ্বিতীয় মিলনকালে রাধার ‘মনত তবে জাগিল মদন’। ভার ও ছত্রখণ্ডে রাধার প্রেম – ব্যাপারে বেশ খানিকটা উন্নতি লাভ করেছে। ভারখণ্ডে দেখা যায়, Ñ ‘ছত্র ধর কাহ্নাঞি দিবো সুরতী। ’ বৃন্দাবন খণ্ডে কৃষ্ণের প্রতি রাধার প্রেম গভীরতায় এসে পোঁছেছে। কালীয়দমনখণ্ডে রাধা সকলের সামনে কৃষ্ণকে ‘পরাণ পতী’ বলে সম্বোধন করেছে। বানখণ্ডের শেষাংশে রাধা – কৃষ্ণের মিলনের মধ্যে দিয়ে পুরাতন প্রেম পুনরায় নবীন হয়ে উঠল। বংশীখণ্ডে কৃষ্ণের প্রতি রাধার প্রেমের পরিণতি ঘটেছে। এখানে রাধার মধ্যে বিরহজনিত গভীর ব্যাকুলতা দেখা দিয়েছে। কৃষ্ণের বাঁশির সুর শুনে রাধিকার চিত্ত উন্মাদ জয়ে উঠেছে। এতদিন সে নিকট থেকে কৃষ্ণের রূপ দেখেছে, এবার দূর থেকে সে কৃষ্ণের স্বরূপ উপলব্ধি করল। কৃষ্ণের বংশীধ্বনি শুনে রাধা ব্যাকুল হয়ে বলে-

কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কলিনী নইকুলে
কে না বাঁশী বাত্র বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে
আকুল শরীর মোর বেআকুল মন
বাঁশীর শবদেঁ মোঁ আউলাইলোঁ রান্ধন ।

এই হলো শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা চরিত্র।

বৈষ্ণব কবিরা রাধাকে নিয়ে অনেক পদ রচনা করেছেন। এ সব কবিদের মধ্যে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, ও গোবিন্দ দাস অন্যতম। এই চারজন কবি বিখ্যাত, তারা রাধাকে নিয়ে নানা রকম পদ রচনা করেছেন। যে কবিই রাধাকে নিয়ে পদ রচনা করুক, এখানে রাধাকে প্রথমেই কৃষ্ণ চরিত্রের জন্য ব্যাকুল হতে দেখা যায়। পদাবলির রাধা প্রথম থেকেই কৃষ্ণপ্রেমে বিভোর। কোন কোন গবেষক এখানে জীবাত্মা ও পরমাত্মার সম্পর্ক দেখিয়েছেন। বৈষ্ণব পদাবলিতে রাধা শ্রীকৃষ্ণের জন্য ধ্যান করতে থাকে। সব সময় তার মুখে কৃষ্ণ নাম। কৃষ্ণ নাম জপতে জপতে গাভীর দুধ দোহন করে। গাভী চলে গেছে, দুধের পাত্রও নেই; রাধা দোহন করেই চলছে। এখানে লাখ লাক যুগ কৃষ্ণকে দেখেও রাধার দেখার ইচ্ছা মেটে না। রাধা কৃষ্ণের সাথে মিলনের জন্য ব্যাকুল এমনকি বৃষ্টির দিনে রাধা অভিসারের তপস্যা করছে। এখানে কবি বিদ্যাপতির একটি কবিতার কয়েকটি চরণ উল্লেখ করতে চাই-

কণ্টক গাড়ি কমল সম পদতল
মঞ্জীর চিরহি ঝাঁপি
গাগরি বারি ঢারি করি পিচ্ছল
চলতহি অঙ্গুলি চাপি।

এই কবিতাংশে দেখা যায় যে, রাধা অভিসারের যাওয়ার জন্য বৃষ্টির দিনে উঠানে পানি ঢেলে সেখানে হাটার অনুশীলন করছে। রাধা তার মনের দুঃখ সখিকে উদ্দেশ্য করে বলছে

সই! কেমনে ধরিব হিয়া?
আমার বঁধুয়া                 আন বাড়ি যায়,
আমার আঙিনা দিয়া!

এভাবে রাধার বিরহব্যথা নানা কবির কবিতায় ফুটে উঠেছে। তবে বিরহ ব্যথায় কখনো কখনো রাধা কৃষ্ণের জন্য অভিশাপ দিচ্ছে এমন কবিতাও আমরা দেখতে পাই। এখানে এ রকম কবিতার কয়েকটি চরণ উল্লেখ করতে চাই-

যুবতী হইয়া শ্যাম ভাঙ্গাইয়া
এমতি করিল কে?
আমার পরাণ যেমতি করিছে
সেমতি হউক সে!

রাধার প্রেমের কারণে কলঙ্ক রটে গেলে তাতে রাধা কোন চিন্তা-ভাবনা নেই। বরং এ কলঙ্ক নাম শুনে আরো সে তৃপ্ত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রাধা বলেছে

তোমার লাগিয়া            কলঙ্কের হার

গলায় পরিতে সুখ।।

রাধা কাক পাখিকে তার চোখ দুটি না খাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে। সর্বাঙ্গ খেয়ে ফেললেও রাধার কোন আফসোস নেই। শুধু কৃষ্ণকে দেখার জন্য চোখ দুটি যেন কাক না খায়। এই হলো বৈষ্ণবপদাবলির রাধা চরিত্র।

পরিশেষে বলা যায়, রাধা চরিত্রের ক্রমবিকাশ সত্যিই অভাবনীয় শিল্পরসের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। এক অপরিণত বয়স্কা নারীর মন ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে গেছে। রাধার ক্রমবিকাশ প্রকৃত মানবীর প্রকৃতি ও প্রবৃত্তির পরিচায়ক। সার্বিক বিচারে দেখা যায় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এর রাধা সম্পন্ন গ্রামীণ নারী চরিত্র। আর বৈষ্ণবপদাবলির রাধা আবেগ-অনুভূতি এবং কামনা – বাসনায় উদ্দীপিত এক পরিণত নারী চরিত্র। বাংলা সাহিত্যে রাধা চরিত্র সে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এ হোক আর বৈষ্ণব পদাবলিরই হোক, বাস্তবিকই রাধা চরিত্রটি অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে। শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, সমগ্র বিশ্বসাহিত্যেও এ রকম চরিত্র বিরল।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।

Scroll to Top