বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ রচনা কর।

মুক্তিযুদ্ধ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ রচনা কর।

ভাষা আন্দোলন থেকে উন্মেষ ঘটে বাঙালি জাতীয়তাবাদের। এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় আওয়ামীলীগ,বিভিন্ন প্রগতিশীল দল ও সংগঠন। নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় মহান স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি: ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানের প্রায় ২৪ বছররের ইতিহাস ছিল পূর্ব বাংলার মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক.অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শোষণ ও নির্যাতনের ইতিহাস। এ সীমাহীন অত্যাচার ও শোষণ-বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তির জন্য মানুষ আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে। তারপর ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন,১৯৬৬ এর ছয় দফা আনেন্দালন,৬৯ এর গণঅভ্যূত্থান,ও ৭০ এর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে বাঙালিদের জাতীয়তাবাদী চেতনা। পাকিস্তানের দমননীতির ফলে রচিত হয় বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামের পেক্ষাপট।

মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ: ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে একটি অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানারকম টালবাহানা ও প্রহসন শুরু করে। অবস্থা বুঝতে পেরে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ স্বাধীনতার ডাক দেন। ফলে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনি নিরিহ বাঙালির ওপর ২৫ মার্চ এর রাতে ঝাপিয়ে পড়ে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে শেখ মুজিব বন্দী হওয়ার পূর্বে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে ইপিআর, পুলিশ, সেনাবাহিনি, ও সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার আহবান জানান। ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষনা করেন।

মুজিবনগর সরকার গঠন: মুক্তিযুদ্ধকে পরিপূর্ণ ও সুসংগঠিত করার জন্য ১৯৭১ সালে ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের ঘোষনা দেয়া হয়। ১৭ এপ্রিল শনিবার তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার ভবেরপাড়ার আমবাগানে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিরা শপথ গ্রহণ করে। তাজউদ্দিন আহমেদ প্রধানমšী¿, শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন। মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন প্রধানমন্ত্রীসহ সাত জন।

মুক্তিবাহিনি: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব প্রদান করা হয় কর্ণেল এম.এ.জি. ওসমানীর উপর। তিনি সববাহিনি পুনর্গঠন করেন। তিনি বাংলাদেশের যুদ্ধাঞ্চলকে ১১টি ভাগে বিভক্ত করেন। এবং সেক্টর কমান্ডারদের ্উপর যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। তার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনি নান প্রতিকুলতা কাটিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অসীম বীরত্বের পরিচয় দেয়।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অবদান: মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রের অবদান ছিল অপরিসীম। চট্টগ্রামের কালুরঘাটের বাংলা বেতার কেন্দ্রর শিল্পীরা দেশপ্রেমমূলক অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করে বিজয়ের পথকে সুগম করেন। মূলত মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অবদান অপরিসীম।

বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিসেবী ও কবিসাহিত্যিকদের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। তানা বিভিন্ন রকম পুস্তিকা রচনা করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। মুক্তিযুদ্ধের সাফ্যল্যে প্রবাসী বাঙালিদের অবদান অতুলনীয়। যারা দেশের ভেতরে ছিলেন তারা নানাভাবে মুক্তিবাহিনিকে সহায়তা করেন।

৪ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনি ও ভারতীয় যৌথবাহিনি পাকবাহিনির বিরুদ্ধে আক্রমন চালায়। যৌথ বাহিনির প্রচণ্ড আক্রমনে পাকবাহিনি পরাজিত হতে থাকে। মাত্র ১২ দিন যুদ্ধের পর অবস্থা বেগতিক দেখে হানাদার বাহিনির অধিনায়ক লে. জেনারেল নিয়াজী তার ৯৩ হাজার সেনাসহ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যৌথবাহিনির কমান্ডার জেনারেল জগজিৎ সিংহ অরোরা ও বাংলাদেশ বাহিনির পক্ষে এ.কে. খন্দকারের উপস্থিতিতে ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ২১ মিনিটে আত্মসমর্পন করে। এ আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের আত্বপ্রকাশ ঘটে। এভাবে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়।

বাঙালি জাতির আত্বনিয়ন্ত্রনের অধীকার প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম,রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তদান, দুই লাখ মা বোনের ইজ্জত লুণ্ঠত.সমগ্র পৃথিবীর স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির ইতিহাসের ধারায় সর্বশ্রেষ্ঠঘটনা। এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুর ।

About সালেক শিবলু

বিএ অনার্স, এমএ (প্রথম শ্রেণি) এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

View all posts by সালেক শিবলু