কাজী নজরুল ইসলামের প্রবন্ধ লোকমান্য তিলকের মৃত্যুতে বেদনাতুর কলিকাতার দৃশ্য

Nazrul Islam
Nazrul Islam

লোকমান্য তিলকের মৃত্যুতে বেদনাতুর কলিকাতার দৃশ্য

[স্মৃতি]

আজ মনে পড়ে সেই দিন আর সেই ঋণ-বিকাল আড়াইটা যখন কলিকাতার সারা বিক্ষুব্ধ জনসঙ্গ টাউনহলের খিলাফৎ-আন্দোলন সভায় তাহাদের বুকভরা বেদনা লইয়া সম্রাটের সম্রাট বিশ্বপিতার দরবারে তাহাদের আর্ত-প্রার্থনা নিবেদন করিতেছিল, আর পুত্রহীনা জননীর মতো সারা আকাশ জুড়িয়া কাহার আকুল-ধারা ব্যাকুলবেগে ঝরিতেছিল। সহসা নিদারুণ অশনিপাতের মতো আকাশ-বাতাস মন্থন করিয়া গভীর আর্তনাদ উঠিল, ‘তিলক আর নাই।’ আমাদের জননী জন্মভূমির বীরবাহু, বড় স্নেহের সন্তান-তিলক আর নাই। হিন্দুস্থান কাঁপিয়া উঠিল- কাঁপিতে কাঁপিতে মুষ্টিত হইয়া পড়িল। ওরে, আজ যে তাহার বুকে তাহ্যরই হিমালয়ের কাঞ্চনজম্মা ধসিয়া পড়িল।

হিন্দুস্থানের আকাশে-বাতাসে কোন্ প্রিয়তম পুত্রহারা অভার্থী মাতার মর্ম-বিদারী কাৎরানি আর বুকচাপড়ানি রণিয়া বলিয়া ওমরিয়া ফিরিতে লাগিল, ‘হায় মেরি ফরজন্দ (হায় আমার সন্তান)-আহ মেরি বেটা।’ এই আর্ত কান্নার রেশ যখন কলিকাতায় আসিয়া প্রতিধ্বনি তুলিল, তখনকার অবস্থা বর্ণনা করিবার ক্ষমতা আমাদের নাই। এত মর্মভেদী কান্না প্রকাশের ভাষা নাই-ভাষা নাই। মহাবাহু মহাপুরুষ অগ্রজের মৃত্যুতে কনিষ্ঠ ভ্রাতারা যেমন প্রাণ ভরিয়া গলা-ধরাধরি করিয়া ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কাঁদে, সেদিন দিন-শেষে ব্যাকুল বৃষ্টিধারার মধ্যে দাঁড়াইয়া আমরা তেমনি করিয়া কাঁদিয়াছি। হিন্দু-মুসলমান, মাড়োয়ারি, বাঙালি, হিন্দুস্থানি কোনো ভেদাভেদ ছিল না, কোনো জাতবিচার ছিল না, তখন শুধু মনে হইতেছিল, আজ এই মহাগগনতলে দাঁড়াইয়া আমরা একই ব্যথায় ব্যথিত বেদনাতুর মানবাত্মা, দুটি স্নেহ-হারা ছোট ভাই! এখানে ভেদ নাই। -ভেদ নাই। সেদিন আমাদের সে-কান্না দেখিয়া মহাশূন্য স্তত্তিত হইয়া গিয়াছে-কাঁঝরা আকাশের করা থামিয়া থিয়াছে, শুধু সে-কার মেঘ-ভরা বেদনাপুত অপলক দৃষ্টি আমাদের নাঙ্গা শিরে স্তন্তু আনত হইয়া চাহিয়া থালিয়াছে। তাই মনে হইতেছিল, বুঝি সারা বিশ্বের বুকের স্পন্দন খামিয়া গিয়াছে। এই স্তম্ভিত নিস্ততোকে ব্যথা দিয়া সহসা লক্ষ কণ্ঠের ছিন্ন-এন্দন কারবালা-মাতমের (কারবালার (শ্যাকাচ্ছাস) মতো মোচড় খাইয়া উঠিল, ‘হায় তিলক।’

ওরে, এ কোন অসহনীয় ক্রন্দন? হায়, কাহার এ-রুক্ষ কণ্ঠের শ্রান্ত রোদন। মনে পড়ে সমস্ত বড়বাজার ছাপাইয়া হ্যারিসন। রোডের সমস্ত স্থান ব্যাপিয়া রোরুদ্যমান দক্ষ লক্ষ লোক মাড়োয়ারি, বাঙালি, হিন্দু-মুসলমান, গন্ধ, যুবক, শিশু, কন্যা-শুধু বুক চাপড়াইতেছে, ‘হায় তিলকজি। আহ তিলকজি!’ মৃত্যুর অমা-ভরা শত শত কৃষ্ণ পতাকা পশ্চিমা ঝন্‌ঝায় থরথর করিয়া কাঁপিতেছে, আর তাহারই নিম্নে মাল্য-চন্দন বিভূষিত বিগত তিলকের জীবন্ত প্রতিমূর্তি! তাহাই কাঁধে করিয়া অযুত লোক চলিয়াছে জাহ্নবীর জলে বিসর্জন দিতে! বাড়ির বারান্দায় জানালায় থাকিয়া আমাদের মাতা-ভগিনীগণ এই পুণ্যাত্মার আলেখ্যের উপর তাঁহাদের পূত অশ্রুরাশি ঢালিয়া ভাসাইয়া দিতেছিলেন। বলিলাম, ধন্য ভাই তুমি! এমনি মরণ, সুখের মরণ, সার্থক মরণ যেন আমরা সবাই মরিতে পারি! তোমার চির-বিদায়ের দিনে এই শেষ আশিস্-বাণী করিয়া যাও ভাই, এমনি প্রার্থিত মহামৃত্যু যেন এই দুর্ভাগা ভারতবাসীর প্রত্যেকেরই হয়!… ওরে ভাই, আজ যে ভারতের একটি স্তম্ভ ভাঙিয়া পড়িল। ভাঙিয়া প স। এ পড়ো-পড়ো ভারতকে রক্ষা করিতে এই মুক্ত জাহ্নবীতটে দাঁড়াইয়া আয় ভাই, আমরা হিন্দু-মুসলমান কাঁধ দিই! নহিলে এ ভগ্নসৌধ যে আমাদেরই শিরে পড়িবে ভাই! আজ বড় ভাইকে হারাইয়া, এই একই বেদনাকে কেন্দ্র করিয়া, একই লক্ষ্যে দৃষ্টি রাখিয়া যেন আমরা ভাইকে, পরস্পরকে গাঢ় আলিঙ্গন করি! মনে রাখিও ভাই, আজ মশানে দাঁড়াইয়া এ স্বার্থের মিলন নয়, এ-মিলন পবিত্র, স্বর্গীয়! ঐ দেখো, এ-মিলনে দেবদূতরা তোমাদের নাঙ্গা-শিরে পুষ্প-বৃষ্টি করিতেছেন। মায়ের চোখের জলেও হাসি ছলছল করিতেছে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *