চর্যাপদ এর সমাজচিত্র আলোচনা কর। 231001

চর্যাপদ এর সমাজচিত্র আলোচনা কর।

চর্যাপদ এর সমাজচিত্র আলোচনা কর। (বাঙালি সমাজ/জীবনধারা)

চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবার থেকে এ পদ আবিষ্কার করেন। তারপর ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষদ থেকে ‘হাজার বছরের পুরাণ বাংলা ভাষার বৌদ্ধ গান ও দোহা’ নামে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের হাজার বছরের সম্পদ। ‘চর্যাপদ’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবার পর থেকে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। চর্যাপদের কবিগণ ধর্মীয় উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এ সব পদগুলো রচনা করেছেন। তবে এ গ্রন্থে তৎকালীন সমাজ জীবনের প্রতিফলন ঘটেছে। প্রাচীন বাঙালির নানা জীবনদর্শন যেমন সামাজিক, রাজনৈতিক, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ও বৈচিত্রময় সামাজিক উপাদান এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। নিচে চর্যাপদে বিধৃত সমাজচিত্র নিয়ে আলোচনা করা হলো-

প্রাচীন বাঙালি সমাজের পরিচয় কেবল ‘চর্যাপদ’ নামক গ্রন্থে পাওয়া যায়। সমাজে কৃষিব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। কৃষকেরা ফসল ফলাতো, আর মোটা অংশ ভোগ করতো উচ্চবিত্তেরা। নিম্নশ্রেণির মানুষের জীবন ছিল অভাবপীড়িত, অবহেলিত। সমাজে উচ্চ-নীচু এ রকম বৈষম্য বিরাজ করছিল। যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করতো তারা সমাজে প্রভাবশালী ছিল। সমাজে মানুষের ধর্ম-কর্ম, আচার আচরণ ছিল বিভক্ত। এ সবকিছু বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’-এ লক্ষ্য করা যায়। সমাজের নীচু স্তরের মানুষের কথা চর্যাপদে প্রতিফলিত হয়েছে। তারা সমাজের অভিজাত মানুষ থেকে দূরে বসবাস করতো। গ্রামান্তে, পর্বতটিলায়। ২৮ সংখ্যক চর্যাপদে এরকম চিত্র পাওয়া যায়-

উষ্ণা উষ্ণা পর্বত তহি বসি সবরী বালী
মোরাঙ্গ পীচ্ছ পরিহাণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।

উচু উচু পর্বত, সেখানে বাস করতো সবরী বালিকা। ময়ুরের পুচ্ছ পরিধানে শবরী, গলায় গুঞ্জার মালা। নগরের বাইরে অন্ত্যজ মানুষের বসবাস। ১০ সংখ্যক চর্যায় বলা হয়েছে-‘নগরের বাহিরে ডোম্বি তোহরী কুড়িয়া’- অর্থাৎ নগরের বাইরে ডোম্বী মেয়েদের কুড়ে ঘর। ‘টালত মোর ঘর নাহি পড়বেসী’ – টিলায় আমার ঘর, কিন্তু কোন প্রতিবেশি নেই। ৩৩ সংখ্যক চর্যাপদ-এ জনবসতির বাইরে বসবাসের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।

লোকালয় থেকে দূরে উচ্চভূমিতে যাদের বাস, তাদের জীবিকা উপার্জনের পথও স্বতন্ত্র্য। তাদের আর্থিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত বিপর্যস্ত। তেমন কোন সম্মানজনক অবস্থান বা সম্পদ তাদের ছিল না। ফলে তারা সমাজে অস্পৃশ্য ছিল। কাপালিক, ব্যাধ, যোগী, ডোম্বী, চ-ালী, শবরী, তাঁতি, ধুনুরী, শুড়ি, মাহুত, নট-নটী প্রভৃতি নিম্নস্তরের মানুষের জীবনযাত্রা চর্যাপদে বর্ণিত হয়েছে। তাদের জীবনজীবিকা কখনো সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পরিচয় বহন করে না। কয়েকটি চর্যাপদে ব্যাধবৃত্তির কথা বলা হয়েছে। ব্যাধ কতৃক হরিণ শিকারের বর্ণনা ভুসুকুপাদের ৬ সংখ্যক কবিতায় আছে। ডোম্বীদের বৃত্তি ছিল তাঁত বোনা ও চাঙ্গারি তৈরি করা। কারো অন্যতম বৃত্তি ছিল মদ চোয়ানো।
জীবনে সুখ-শান্তির কোন ছোঁয়া ছিল না। বসবাস সমাজ সংসার থেকে দূরে, প্রতিবেশিহীন, টিলার উপর ঘর; হাঁড়িতে ভাত নেই। কিন্তু সেখানে নিত্য অথিতির আনাগোনা। দুঃখ আর অশান্তি তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। ঘরে খাবার নেই, অথচ ব্যাঙের ছাতার মতো সংসার বেড়ে চলছে। এ প্রসঙ্গে একটি কবিতার চরণ উল্লেখ্য-

হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী
টালত মোর ঘর নাহি পড়বেশী
বেঙ্গ সংসার বড়হিল যাঅ।

চোর রাতে চুরি করতো আর দিনে সাধু সেজে থাকতো। এসব সামাজিক নিদর্শন প্রাচীন সাহিত্যে পাওয়া যায়।‘ কানেট চোরে নিল অধরাতী’- সমাজের নৈতিক অবস্থান উচুতে ছিল না। নাগরালি, কামচ-ালী, ছিনালী, পতিতা লম্পট এ রকম চরিত্রের মানুষ সমাজে বিদ্যমান ছিল। সমাজের খ-খ- চিত্র চর্যাপদে বিধৃত আছে। তৎকালীন সমাজের বাঙালি আচার-ব্যবহার , রীতি-নীতির আভাস চর্যাপদে পাওয়া যায়া। একাধিক চর্যাপদে উল্লেখ থাকায় মনে হয় শ্বশুড়-শাশুড়ি, দেবর-ননদ-শালী নিয়ে বাঙালি সংসার গড়ে উঠেছিল। গো-পালন আর দুগ্ধ দোহনের কথা চর্যাপদে উল্লেখ আছে। তখন বলদের ব্যবহার ছিল,্ হাতির ব্যবহারও অজানা ছিল না। কেবল ছিল অবসর বিনোদনের উৎস। মদ পান, কর্পুর দিয়ে পান খাওয়া, নাচ- চর্যাপদে পদ্মা নদীর উল্লেখ আছে। ব্যবসা-বাণিজ্য এ পথে চলতো। দেশে চুরি-ডাকাতির প্রভাব ছিল, পথ চলা নিরাপদ ছিল না। মদপান, পান খাওয়া, নাচ-গান ইত্যাদি ছিল সামাজিক জীবনের বিনোদনের উপায়। এমনিভাবে চর্যাপদে তৎকালীন জীবনযাত্রার নানা উপাদানের পরিচয় পাওয়া যায়।

উপযুক্ত আলোচনা, পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যায় যে, যে কবিরা চর্যাপদে তৎকালীন সমাজের নানাবিধ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় বর্ণনা করেছেন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, বর্ণপ্রথা, উচু-নীচু, অভাব-অনটন, অনাচার, চুরি-ডাকাতি এমনকি মানুষের নৈতিক ও চারিত্রিক অধপতন-এসব চিত্র পদকর্তরা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে চর্যাপদে উল্লেখ করেছেন। তাই ‘চর্যাপদ’ প্রাচীন বাংলার সমাজদর্পণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *