কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের অবলম্বনে নবকুমার চরিত্রটি আলোচনা কর।
বাংলা উপন্যাসের প্রথম সার্থক ও শ্রেষ্ঠ রূপকার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) এর এক মহৎ সাহিত্য কর্ম ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬)। তিনটি প্রধান চরিত্রের মধ্যে নবকুমার একটি অন্যতম কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্র। প্রশ্নের চাহিদা মোতাবেক আমরা এখন নবকুমার চরিত্রটি আলোচনা করব।
নবকুমারের পরিচয় সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়-সে জাতিবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়তে ব্রাক্ষণ, রাঢ়ীয় শ্রেণি, সপ্তগ্রামের অধিবাসী। পুরো নাম নবকুমার শর্ম্মা। প্রথম জীবনে রামগোবিন্দ ঘোষালের কন্যা পদ্মাবতীকে বিয়ে করে। তারপর পিতার কারণে জাতিভ্রষ্টা পদ্মাবতীর সাথে বৈবাহিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। নবকুমার বিরাগবশত আর বিয়ে করে নি।
নবকুমার সহজ সরল স্বভাবের পুরুষ চরিত্র। তার মধ্যে সব ধরণের মানবিক গুণাবলির সমাবেশ আছে। পরোপকার, পরদুঃখকাতরতা তার অন্যতম গুণ। সে দরিদ্র ব্রাক্ষণের সন্তান নয়। পিতৃহীন হলেও কঠোর শারীরিক পরিশ্রম করার অভ্যাস তার ছিল না। তবুও অনেক পরিশ্রম ও কষ্ট সহ্য করে, হিংস্র জীব-জন্তুর ভয় উপেক্ষা করে, কুঠার হাতে নিয়ে বনে গমন করে এবং কাঠ আহরণ করে-এমনি পরোপোকারী একটি চরিত্র নবকুমার।
গহীন অরণ্যে কপালকুণ্ডলা কাপালিকের হাত থেকে নবকুমারের জীবন রক্ষা করে। তাই নবকুমার কপালকুণ্ডলার প্রতি চির কৃতজ্ঞ। অধিকারীর প্রস্তাবে নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে বিয়ে করতে নির্দ্বিধায় সম্মতি জানায় এবং এক গোধূলি লগ্নে দুজনের বিয়ে সম্পন্ন হয়।
বৈবাহিক জীবনে নবকুমার একজন আদর্শ স্বামীর মত স্ত্রীর প্রতি সব দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে। পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় নিজে পায়ে হেঁটে যায় কিন্তু স্ত্রী কপালকুণ্ডলার জন্য একজন দাসী ও শিবিকাবাহক নিযুক্ত করে। কপালকুণ্ডলাকে ভালবেসে সে মৃন্ময়ী’ বলে ডাকে। হৃদয় উজাড় করে অজস্র ভালবাসায় কপালকুণ্ডলার জীবন-মনকে আনন্দ দিয়ে ভরিয়ে তুলতে চায়, অন্ধকার অতীত থেকে তাকে আলোর জগতে নিয়ে আসতে চায়। বিনিময়ে সে পায় অথৈ উদ্বেগ।
নবকুমারের প্রথম জীবনের স্ত্রী পদ্মাবতী সপ্ত গ্রামে এসে নবকুমারের কাছে নিজেকে সর্ম্পন করলে নবকুমার সরাসরি তাকে প্রত্যাখান করে। এখন তার ঘরের মধ্যে স্ত্রী কপালকুণ্ডলা। কপালকুণ্ডলা মঙ্গল চিন্তায় নবকুমারের সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। তাই নিবিড় বনমধ্যে কপালকুণ্ডলা ঔষধি গাছ তুলতে যেতে চাইলে নবকুমার বিপদে আশঙ্কায় তা সমর্থন করেনি।
নবকুমার রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। তার মধ্যে যেমন ভালবাসা-স্বামী সোহাগ আছে তেমনি আছে সন্দেহ-সংশয়। একটি চিঠি হাতে পাওয়র পর নবকুমারের মনে সন্দেহের বীজ অঙ্কুরিত হয় এবং দ্রুত তা শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে ওঠে। নবকুমারের হৃদয়ে শুরু হয় রক্তক্ষরণ। তারপর কাপালিক কপালকুণ্ডলা ও ব্রাক্ষণকুমারের দৈহিক মিলনের কালপনিক কাহিনী উপস্থাপন করে। কপালকুণ্ডলার অসতীত্ব প্রমাণের জন্য কাপালিক অনেকদূর থেকে ছদ্মবেশি ব্রাক্ষণ ও কপালকুণ্ডলার সাক্ষাতের দৃশ্য নবকুমারকে দেখায়। নবকুমার স্বচোখে দুজনের সাক্ষাতের দৃশ্য দেখে সঙ্গে সঙ্গে ভূতলে পড়ে যায়। কাপালিক তৈরি মদিরা পান করে নবকুমারের বিচার জ্ঞান রহিত হয়। এ সময় নবকুমার কপালকুণ্ডলার মত সতী-সাধ্বী স্ত্রীকে কাপালিকের হতে তুলে দেওয়ার মত সাংঘাতিক ভুল সিদ্ধান্ত নেয়।
নবম পরিচ্ছেদ : প্রেতভূমিতে নবকুমার, কপালকুণ্ডলা ও কাপালিককে সাগর সৈকতে শশ্মানে দেখতে পাই। কাপালিক তান্ত্রিক বিধান অনুসারে পুজার আয়োজন করে। আর নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে স্নান করানোর জন্য হাত ধরে শশ্মান ভূমির ওপর দিয়ে সাগর তীর অভিমুখে যায়। ইতোমধ্যে কাপালিক তৈরি মদিরার প্রভাব নবকুমারের মধ্যে আস্তে আস্তে প্রশমিত হয়ে আসে। পূর্বাকশে সূর্যোদয়ের মত নবকুমারের মধ্যে চৈতন্যদোয় হয়। নবকুমার বুঝতে পারে-যে নারী তার জীবন দান করেছে, তাকে সে হত্যা করতে চলেছে। নবকুমার চিৎকার করে কপালকুণ্ডলার পায়ে লুটিয়ে পড়ে এবং তার আর্ত-চিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। নবকুমারের বিলাপ লেখক উপস্থাপন করেন এভাবে- “একবার বল যে, তুমি অবিশ্বাসিনী নও একবার বল, আমি তোমায় হৃদয়ে তুলিয়া গৃহে লইয়া যাই।” নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে হৃদয়ে তুলে নিয়েছে কিন্তু গৃহে নিয়ে যেতে পারেনি। তীর ধসে কপালকুণ্ডলা নদীতে পতিত হলে তাকে খুঁজতে নবকুমারও সলিলে জীবন বিসর্জন দেয়।
নবকুমার সমগ্র জীবন-যৌবণ দিয়ে কপালকুণ্ডলাকে সুখী করতে চেয়েছে কিন্তু পারেনি। সবশেষে কপালকুণ্ডলার জন্য সলিলে জীবন বিসর্জন দিল। এ রকম নায়ক চরিত্র শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্ব সাহিত্যেও বিরল। তাই নবকুমার চরিত্রটি বঙ্কিমের এক অসাধারণ সৃষ্টি।
সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর