সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত ‘নয়নচারা’ গল্পের মূল প্রতিপাদ্য/মূল বক্তব্য আলোচনা কর । (দুর্ভিক্ষ চিত্র/তৎকালীন সমাজচিত্র )
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-১৯৭১) বাংলা সাহিত্যে একজন গুরুত্বপূর্ণ কথাশিল্পী। বাংলা ছোটগল্পে তিনি বিশেষ অবদান রেখেছেন। তিনি বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে গল্প রচনা করেছেন । তার প্রথম গল্পগ্রন্থ হলো ‘নয়নচারা’ (১৯৪৪)। গল্পগ্রন্থে তিনি বিশেষ শিল্পসত্ত্বার পরিচয় দিয়েছেন। এই গ্রন্থের নাম গল্প ‘নয়নচারা’য় লেখক এ গল্পে সমকালীন সমাজ-জীবনচিত্র ও দুর্ভিক্ষ প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেছেন । গল্পটির মূল বক্তব্য আলোচনা করা হলো-
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ একজন সচেতন শিল্পী । তিনি মানবজীবনকে শৈল্পিক ভাবে বাংলা গল্পে উপস্থাপন করেছেন । তার গল্পগুলোতে মানবজীবনের নানা বিষয় যেমন- সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, সমকালীন জীবনপ্রবাহ, রাজনৈতিক ভাবনা, অভাব-অনটন সব বিষয়ই তিনি অত্যন্ত সচেতন ভাবে গল্পে উপস্থাপন করেছেন । গল্পগুলো ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সব গল্পই শেষ পর্যন্ত একটি মানবিক পরিণতি অর্জন করেছে। ‘নয়নচারা’ গল্পটি ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের পেক্ষাপটে রচিত।
নয়নচারা
‘নয়নচারা’ গল্পটিতে নয়নচারা গ্রামের আমু নামের একজন অভাবী ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে । গল্পটির কাহিনি মতে জানা যায়, আমু গরীব মানুষ; সে নয়নচারা গ্রামে বাস করে । ১৯৪৩ সালে একটি বড় দুর্ভিক্ষ আসে । এ সময় সারা দেশে ব্যাপক খাদ্যের অভাব দেখা দেয় । প্রচুর লোক অনাহারে না খেয়ে মারা যায় । আমু এই দুর্ভিক্ষে বিপদে পড়ে । বেঁচে থাকার মতো তার খাবার নেই। তখন আমু এক মুঠো সাদা ভাতের জন্য প্রাণে বেঁচে থাকার জন্য শহরে আসে । শহর সম্পর্কে আমুর ইতিবাচক ধারণা ছিল । শহরে বড় লোক মানুষ বাস করে । তাঁদের প্রচুর টাকা পয়সা আছে সেখানে আমুর মতো গরীব মানুষ অন্তত সাদা ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে পারবে। তাই আমু নয়নচারা গ্রাম থেকে শহরে এসেছে । শহরে এসে আমুর ধারণা পরিবর্তন হয় । আমুর তিক্ত অভিজ্ঞতা লেখক এ গল্পে উপস্থাপন করেছেন ।
আমু দেখেছে, শহরে ফুটপাত আছে, সেখানে প্রচুর মানুষ না খেয়ে শুয়ে রয়েছে । আমুর খাবার জোটেনি । আমু না খেয়ে ফুটপাতে শুয়ে রয়েছে । আমুর পাশে একজন ভূতনি বুড়ি রয়েছে; সেও থক থক করে কাশছে । পুরো শহর শান্ত। আমু লক্ষ করেছে যে, সে গ্রামে যে তারাগুলো আকাশে দেখতো; সেই তারাগুলোই শহরে এসেছে। তারাগুলো আমুর ভালই লাগে আমু গ্রামকে গভীরভাবে অনুভব করে । সেখানে ভাঙ্গা মাটি আছে, শস্য, ঘাস আর ময়ুরাক্ষী নদী আছে। শহরে নদী নেই, মানুষের দয়ামায়া নেই । আছে কেবল হিংসা, নিষ্ঠুরতা, শত্রুতা আর কত খারাপ জিনিস । আমু রাস্তায় একজন লোক দেখতে পায়, যার চোখ শয়তানের চোখের মতো; সে চোখ লাল, হাতে বিড়ি। আমু শহরে কুকুর দেখেছে কিন্তু কুকুরের চোখে বৈরিতা নেই, মানুষের চোখে বৈরিতা আছে । অর্থাৎ শহরের মানুষগুলো কুকুরের মতো আমু হতাশ হয় অনাহারে থাকলেও আমুর চোখে ঘুম আসে। আমু শহরের ময়রার দোকান দেখছে। সেখানে মিষ্টির লোভে মাছি বৌ বৌ করছে। আমু দাঁড়াতেই দোকানদার আমুকে তেড়ে আসে । আমু লক্ষ করছে- দোকানদারের চোখে পাশবিকতা; সেখানে আগুন জ্বলছে। কোন মানবিকতা নেই, কোন দয়ামায়া নেই। অথচ আমু শহরের মানুষের একটু মায়া পাওয়ার জন্যই শহরে এসেছিল । আমু অন্য দোকানে এক কাদি কলা ঝুলতে দেখে আমুর মনে হয় এগুলো কলা নয়, যেন স্বপ্ন ঝুলছে। আমু ভয় পায়; কলাগুলো আবার খুলে মাটিতে পড়ে যাবে না তো ? পেটের ক্ষুধার জ্বালায় আগুন ধরে যায়। অথচ এ শহরের কেউ আমুর দিকে ফিরেও তাকায় না । আমু দেখেছে, এ শহরের কত ব্যবসায়ী আছে; কত চাকরিজীবী আছে; কত ধনিক শ্রেণি আছে। কিন্তু কেউ আমুর মতো পথচারীর দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে না । আমু পেটের ক্ষুধায় অস্থির হয়ে ওঠে । শেষে আমু গ্রামের কথা মনে করে হু হু করে কেঁদে ওঠে- ‘কোথায় গো কোথায় গো নয়নচারা গাঁ?’ আমু লালপেড়ে শাড়ি পড়া একটি মেয়েকে দেখতে পায়। মেয়েটি আমুকে দুটি পয়সা দিয়ে যায়।
ভুতনির কাশি আর কান্না; ভূতনির ভাই না খেয়ে মরে গেছে । তাই ভুতনি কাদছে । তাছাড়া পেটে ক্ষুধা তো আছেই । আমু শহরের মানুষের ব্যস্ততা লক্ষ করে । আমু বহু পথ ঘুরেছে কিন্তু ও পথগুলো তার জন্য নয় । আমু জানে যে এ পথে চলে লাভ নেই। এ পথের শেষ নেই । এ পথ দিয়ে ঘরে পৌঁছানো যায় না । আমুর পেটে খাবার নেই । কিন্তু শহরের মানুষগুলোর টাকা ঝনঝন করছে । তারা আসছে, দোকানে বসছে, খাচ্ছে আর চলে যাচ্ছে। আমু অনেকগুলো কুকুরের চিৎকার শুনতে পায়। দূর দূর বলে চেঁচিয়ে এ সব কুকুর তাড়ানোর জন্য চেষ্টা করে। পরে আমু বুঝতে পারে যে এগুলো কুকর নয়, মানুষ। শহরের মানুষের আচরণ কুকুরের মতোই । কুকুর যেমন মায়াহীন; শহরের মানুষগুলোই তেমনই মায়াহীন । আমুর কাছে শহর বিচিত্র মনে হয়। ক্ষুধার যন্ত্রণায় আমু একটি বাড়ির দরজায় করাঘাত করে। একটি মেয়ে বেরিয়ে এসে আমুকে একটু ভাত দেয়। আমু ভাত নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে আর অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে ‘নয়নচারা গাঁয়ে কী মায়ের বাড়ি ?’ মেয়েটিও একটি বিস্মত হল এবং কোন জবাব না দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনায় দেখা যায় যে, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে মানুষ কী পরিমাণ বিপদের মধ্যে ছিল- এই বিষয়টি লেখক এ গল্পে উপস্থাপন করেছেন । মানুষ অসহায়ভাবে পথে বসে ঘর-বাড়ি ছেড়ে শহরে আসে; উদ্বাস্তু জীবন-যাপন করে। কিন্তু শহরের বিত্তবান মানুষ গরীব মানুষের দিতে তাকায়নি । লেখক অত্যন্ত সফলভাবে এ গল্পে সমকালীন সময়ের সমাজচিত্র উপস্থাপন করেছেন । বিষয়বস্তু নির্বাচন গল্পের কাহিনি বর্ণনা ও উপস্থাপনার শৈল্পিকগুণে ‘নয়নচারা’ একটি শিল্পসফল গল্প ।
সালেক শিবলু. এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর