ভাড়ুদত্ত চরিত্রটি বিশ্লেষণ কর। 211003

ভাড়ুদত্ত চরিত্রটি বিশ্লেষণ কর। অথবা, (নায়ক চরিত্র অপেক্ষা খল চরিত্র শ্রেষ্ঠ / ভাড়–দত্ত খল হয়েও অসাধারণ / অপ্রধান চরিত্র / চরিত্র চিত্রণে কবির দক্ষতা) ।

মধ্যযুগের সাহিত্যে মঙ্গলকাব্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শাখা। বাংলা সাহিত্যে অনেক মঙ্গলকাব্য রয়েছে । তন্মধ্যে চণ্ডীমঙ্গল অন্যতম। এ মঙ্গলকাব্যের একটি বিশেষ অংশের নাম হলো কালকেতু উপাখ্যান। এ উপাখ্যানের কাহিনি সামান্য হলেও চরিত্রগুলো অসামান্যভাবে ফুটে উঠেছে। এটি কবি মুকুন্দ্ররাম চক্রবর্তীর চরিত্রচিত্রণের দক্ষতার পরিচয় বহন করে। মুকুন্দ্ররাম চক্রবর্তী একজন বাস্তববাদী কবি। তাঁর হাতে নির্মিত চরিত্রগুলোও বাস্তববাদী ও অত্যন্ত জীবনঘনিষ্ঠ। ভাড়ুদত্ত এ রকমই একটি জীবনঘনিষ্ঠ চরিত্র। কালকেতু উপাখ্যানের কাহিনি অনুসারে নিম্নে চরিত্রটি বিশ্লেষণ করা হলো-

উপাখ্যানের কাহিনিতে ভাড়ুদত্তের বংশপরিচয় তার নিজের উক্তিতেই পাওয়া যায়। পিতার নাম হরিদত্ত, পিতামহ জয়দত্ত, অনান্যদের মতো গুজরাট নগরে নবাগত। সামাজিক পতিপত্তি, বিত্তবৈভব, কুলমর্যাদা কোনটাই তার নেই। ভাড়ুদত্ত এ উপাখ্যানের নায়ক চরিত্রও নয়। কিন্তু নায়ক চরিত্র কালকেতু অপেক্ষা ভাড়–দত্ত চরিত্রটি অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে। ভাড়ুদত্ত চরিত্রের কর্মকাণ্ড বিচার করলে দেখা যায় যে, এ চরিত্রের প্রতিটি পদক্ষেপ জীবনঘনিষ্ঠ ও বাস্তববাদী। ভাড়ুদত্ত চরিত্রটি যতটা কৌশলী ততটাই জীবনমুখী। প্রতিটি প্রদক্ষেপ ও ভাবনায় তার কৌশলীমনের পরিচয় বহন করে। ভাড়ুদত্ত নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আসলরূপ গোপন করে বাইরে একজন ভাল মানুষ সেজে থাকে। একজন অপরিচিত মানুষ হয়েও অত্যন্ত কৌশলে কালকেতুর আস্থা অর্জন করে এবং হাটের তোলা তোলার দাায়িত্ব লাভ করে। একপর্যায়ে ভাড়ুদত্ত ছেঁড়া ধূতি থেকে সম্পদশালীতে পরিণত হয়।

ভাড়ুদত্ত একটি লোভী চরিত্র। অর্থের প্রতি তার প্রচণ্ড লোভ। হাটের খাজনা তোলার দাায়িত্ব পেয়ে সে আর অর্থের লোভ সংবরণ করতে পারেনি। আস্তে আস্তে ভাড়ুদত্তের আসল চেহারা উন্মোচন হয়। হাটুরিয়াদের সাথে সে প্রতিনিয়ত খারাপ আচরণ করে। নির্ধাারিত খাজনার অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে। অন্যায়ভাবে ভয় দেখিয়ে হাটুরিয়াদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে। নিজে বাকীতে কেনাকাটা করে, ফাও খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়, এক পর্যায় ভাড়ুদত্ত চরিত্রটি হাটুরিয়াদের নিকট এক আতঙ্কে পরিণত হয়। ভাড়ুদত্তের অত্যাচারে হাটুরিয়াদের জীবন বিষিয়ে উঠে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, হাটুরিয়ারা ভাড়ুকে দেখলেই পসরা লুকিয়ে ফেলে। হাটুরিয়ারা অভিযেগ করলে কালকেতু অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পায় এবং ভাড়ুদত্তকে দাায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়।

কালকেতু একটি বর্তুল চরিত্র। সময়ে সময়ে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে নিজের রূপ বদলায়। উদ্দেশ একটাই- নিজের স্বার্থ উদ্ধার। খাজনা তোলার দায়িত্ব থেকে অব্যহতি পাওয়ায় ভাড়ুদত্ত কালকেতুর উপর অত্যন্ত রুষ্ট হয়। কালকেতুকে উচিৎ শিক্ষা দিতে চায়। দুমুঠো ভাতের প্রয়োজনে ভাড়ুদত্ত একসময় কালকেতুর পায়ে প্রণাম করেছে। আবার সেই ভাড়ুদত্ত এখন কালকেতুকে রাজ্য থেকে বিতাড়নের ষড়যন্ত্র করছে। ভাড়ুদত্ত

কালকেতুকে শাাসিয়ে যায় এভাবে-
হরিদত্তের বেটা হই, জয়দত্তের নাাতি
হাটে লইয়া বেচাইব বীরের ঘোড়া হাাতি।

ভাড়ুদত্ত কলিঙ্গরাজ্যে ফিরে যায় এবং কলিঙ্গরাজার নিকট কালকেতুর কুৎসা রটায়। ভাড়ুদত্তের প্ররোচনায় কলিঙ্গরাজ কালকেতুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কালকেতু যুদ্ধের ভয়ে পাালিয়ে যায়। ভাড়ুদত্ত মিথ্যা বলে কালকেতুর সাথে প্রতারণা করে। কালকেতুর মুক্তির কথা বলে প্রকারন্তে কালকেতুকে ধরিয়ে দেয়। ভাড়ুদত্তের ষড়যন্ত্রে পা দিয়ে কালকেতু কলিঙ্গরাজার নিকট বন্দী হয়। কিন্তু এ বন্দীদশা বেশিদিন ছিল না। দেবীচণ্ডী বরে কালকেতু মুক্তি পায় এবং আবার রাজ্য ফিরে পায়। তখন ভাড়ুদত্ত আবার রূপবদল করে। ভাড়ুদত্ত আপনজন সেজে কালকেতুর নিকটে আসে, চোখের জল ফেলে, বৃষ্টি অনুসারে ছাতা ধরে, কালকেতুর অনুগ্রহ পেতে সে নতুন কৌশল অবলম্বন করে। কালকেতুর উদ্দেশ্যে ভাড়ুর নতুন অভিনয় –

তুমি খুড়া হৈলে বন্দী অনুক্ষণ আামি কাান্দি
বহু তব নাাহি খায় ভাত।

এভাবে দেখা যায় যে, ভাড়ুদত্ত চরিত্রটি সময়ে সময়ে রূপ বদল করেছে। স্বার্থ হাাতিয়ে নেওয়ার জন্য পায়ে প্রণাম করতে পারে, আবার স্বার্থে ব্যঘাত ঘটলে প্রতিশোধ নিতে প্রতিজ্ঞা করে। আসলে ভাড়ুদত্ত একটি প্রতারক ও ঠক চরিত্র। মানুষের সাথে প্রতারণা করাই তার স্বভাব। তবে ভাড়ুর শেষ রক্ষা হয়নি। অপরাধের শাাস্তি স্বরূপ ভাড়ুর মাথা মুড়িয়ে, ঘোল ঢেলে, বাজনা বাাজিয়ে তাকে রাজ্য থেকে তাাড়িয়ে দেওয়া হয়।

উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ভাড়ুদত্ত একটি প্রতারক চরিত্র। জীবনের তাাগিদে ভাড়ুদত্ত কালকেতুর সাথে প্রতারণা করেছে। পরিণামে শাাস্তি পেয়েছে। আবার যে কোনভাবে সে সমাজে নিজেকে মাানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে । সবকিছু মিলিয়ে ভাড়ুদত্ত চরিত্রটি তাই জীবন্ত ও প্রাণবন্ত। ভাড়ুদত্ত চরিত্রের মধ্য দিয়ে মুকুন্দরামের শিল্পীসত্তা অমর হয়ে থাকবে।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।

Scroll to Top