মনসামঙ্গল কাব্যধারার কবিদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। 221003

মনসামঙ্গল কাব্যধারা

মনসামঙ্গল কাব্যধারার কবিদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাব্যধারা। দেব-দেবীদের প্রাধান্য এ সব কাব্যে লক্ষ্য করা যায়। মানুষ অসহায়, বিপদে দেবতা এসে মানুষকে উদ্ধার করে। এ সব কাব্যের সঙ্গে ধর্মের একটি সম্পর্ক বিদ্যমান আছে। দীর্ঘদিন ধরে কবিরা এ সব কাব্য রচনা করেছেন। মঙ্গলকাব্য মধ্যযুগের সাহিত্যধারা সমৃদ্ধ করেছে। তন্মধ্যে প্রধান প্রধান মঙ্গলকাব্য মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল. অন্নদামঙ্গল, শিবমঙ্গল, কালিকামঙ্গল প্রভৃতি। মনসামঙ্গল সবচেয়ে প্রাচীন মঙ্গলকাব্য। বেশ কয়েকজন কবি দীর্ঘকাল যাবৎ এ কাব্য সৃষ্টি করেছেন। প্রশ্নানুসারে নিম্নে মনসামঙ্গল কাব্যধারার কবিদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া হলো-

১. কানাহরি দত্ত : মনসামঙ্গলকাব্যের প্রথম রচয়িতা কবি কানাহরি দত্ত। কানাহরি দত্ত পূর্ববঙ্গের মানুষ ছিলেন। কানাহরি দত্তের লেখা সম্পন্ন মঙ্গলকাব্যটি পাওয়া যায় নি। তবে কিছু কিছু পদ পাওয়া গেছে। এতেই কানাহরি দত্তের কবিত্বের পরিচয় পাঠকের কাছে সুষ্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেবী মনসাকে নিয়ে কবিতা লেখায় তিনি আগ্রহী ছিলেন।

২. নারায়ণ দেব : মনসামঙ্গল কাব্যধারা একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি কবি নারায়ণ দেব। তিনি বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার অধিবাসী ছিলেন। চাঁদ সওদাগর, বেহুলা, লখিন্দরের কাহিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর কাব্য এ দেশে এখনো অত্যন্ত জনপ্রিয়; কাহিনি ও চরিত্র নির্মাণে তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি এ কাব্যের নামকরণ করেছিলেন ‘পদ্মপুরাণ’। সমস্ত কাহিনিকে তিনি তিনটি খ-ে বিভক্ত করেছিলেন। চাঁদ সওদাগর চরিত্রটি তাঁর অপূর্ব নির্মাণ। অত্যন্ত বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই চাঁদ সওদাগর চরিত্র।

৩. বিজয় গুপ্ত : কবি বরিশাল জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। কবিতায় তিনি নিজের পরিচয় বর্ণনা করেছেন। এই এলাকার একজন জনপ্রিয় কবি। মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করে তিনি আরো জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁর জনপ্রিয়তার কাছে অনেক কবির মর্যাদা ম্লান হয়ে যায়। তাঁর কাব্যে সমকালীন সময়ে বেশ কিছু সমাজচিত্র পাওয়া যায়। কাহিনি বর্ণনা ও উপস্থাপনায় কবির বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। ‘মনসামঙ্গল’ কাব্য রচনা করে তিনি বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন।

৪. বিপ্রদাস পিপিলাই : তিনি কলকাতার চব্বিশ পরগণার মানুষ ছিলেন। বাংলার প্রাচীন জনপদ গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহের সময় তিনি এ কাব্যটি রচনা করেন এবং নামকরণ করেন ‘মনসাবিজয়’। এই কাব্যে মোট নয়টি পালা আছে। এ কাব্যে অনেক কাহিনি-উপকাহিনি সংযুক্ত রয়েছে এবং এতে কাব্যের মান বৃদ্ধি পেয়েছে। কাব্যের কাহিনি দেখে বোঝা যায়, তিনি বেশ পরিকল্পিতভাবে এ কাব্য-কাহিনি সাজিয়েছেন এবং সফলতা লাভ করেছেন। মঙ্গলকাব্য ধারায় ‘মনসাবিজয়’ সবচেয়ে বড় কাব্য।

৫. দ্বিজ বংশীজাত : মনসামঙ্গল কাব্যধারার একজন অন্যতম কবি দ্বিজ বংশীদাস। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। কেবল লেখক নয়; গায়ক হিসেবেও দ্বিজ বংশীদাসের বেশ খ্যাতি আছে। ভাষাপ্রয়োগে দ্বিজ বংশীদাসের দক্ষতা অতুলনীয়। মনসার সঙ্গে চ-ীর দ্বন্দ্ব-বিবাদ এ কাব্যের আসল সৌন্দর্য। বেহুলার দুঃখের বর্ণনায় তিনি সহানুভূতিশীল ছিলেন। এ কাব্যে চাঁদ সওদাগরের চরিত্রে বলিষ্ঠতা ফুটে উঠেছে। মা সনকার ছয় পুত্র মারা যায়। এতে মা সনকার মাতৃহৃদয়ের হাহাকার অত্যন্ত শিল্পিত ও যৌক্তিকভাবে তিনি এ কাব্যে উপস্থাপন করেছেন।

৬. কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ : তিনি পশ্চিমবঙ্গের কবি। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে তিনি জীবিত ছিলেন। তিনি মঙ্গলকাব্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। কবিতা রচনায় তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। কবির মূল নাম ক্ষেমানন্দ, তাঁর উপাধি কেতকাদাস। কবি ব্যক্তিগত জীবনে দেবী মনসার ভক্ত ছিলেন। বেহুলার দুঃখ বর্ণনার করুণরস সৃষ্টিতে তিনি অসাধারণ কবিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।

৭. বাইশ কবির মনসামঙ্গল : বাংলা মঙ্গলকাব্য ধারায় ‘মনসামঙ্গল’ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মঙ্গলকাব্য। পাঠকপ্রিয় কাব্য হওয়ার কারণে বিভিন্ন কবির বিভিন্ন কাব্য-অংশ সংগ্রহ ও সংকলন করে একটি ব্যতিক্রম মনসামঙ্গল কাব্য রচিত হয়েছে। অনেকে মনে করেন যে, বাইশ জন কবি মিলে এই কাজটি করায় এ কাব্যের নাম হয়েছে ‘বাইশা মঙ্গল’।

উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায়, যে ‘মনসামঙ্গল’ একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় মঙ্গল কাব্য। তাই সময়ে সময়ে একই কাহিনি নিয়ে বিভিন্ন কবি বিভিন্ন নামে এই একই কাব্য রচনা করেছেন। সব কবিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মঙ্গলকাব্যধারায় ‘মনসামঙ্গল’ একটি অসাধারণ সৃষ্টি। এ কাব্যে দেবতার জয় ঘোষিত হলেও মানবের বলিষ্ঠতা অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে। বর্তমান সময়েও এ কাব্যের জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *