রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ধারার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। 221103

রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ধারার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারা হলো রোমান্টিক প্রণয় উপাখ্যান। মানবীয় কল্পনাকে আশ্রয় করে এই জাতীয় কাব্য গড়ে উঠেছে। মুসলিম কবিরা এ কাব্যধারায় বিশেষ অবদান রেখেছেন। তারা রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান রচনার মাধ্যমে মধ্যযুগের কাব্যধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন। কোন কোন কবি আরবি-ফারসিসহ বিভিন্ন কাব্যধারা থেকে বাংলা অনুবাদ করেছেন। এর মাধ্যমে অনান্য ভাষার সাহিত্য সম্পর্কে কিছু অংশ আমরা জানতে পেরেছি এবং এতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভা-ার সমৃদ্ধ হয়েছে। মধ্যযুগের কবিরা প্রেমকে আশ্রয় করে এ জাতীয় সাহিত্যকর্মের কাহিনি নির্মাণ করেছেন। সুন্দর কবিভাষার মাধ্যমে নর-নারীর প্রণয়কাহিনিকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন। নি¤েœ রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানের কাব্যধারার উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

ইউসুফ জোলেখা : বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি শাহ মুহম্মদ সগীর গেীড়ের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের রাজত্বকালে ‘ইউসুফ জোলেখা’ কাব্য রচনা করেন। এ কাব্যে প্রণয়কাহিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ নামে শাহ মুহম্মদ সগীর ব্যতীত ‘ইউসুফ জোলেখা’ কাব্যের অন্যান্য রচিয়তা -আব্দুল হাকিম, গরীবুল্লাহ, গোলাম সাফাতউল্লাহ, সাদেক আলী ও ফকীর মুহম্মদ অন্যতম।

লায়লী মজনু : দৌলত উজির বাহরাম খানের এ কাব্যটি বাংলা রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ধারায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। কবি চট্রগ্রামের ফাতেয়াবাদের অধিবাসী, দৌলত উজির তার পিতার অর্জিত উপাধি। বিভিন্ন গবেষকের মতভেদে কাব্যটি ১৬৬৯ খ্রিষ্টদের মধ্যে লেখা।

কাব্যটি ফারসি কবি জামীর ‘লায়লা ওয়া মাজনু’ কাব্যের ভাবানুবাদ। কিন্তু এ কাব্যের কাহিনির উৎস আরবিয় লোকগাঁথা থেকে। কবি দৌলত উজির বাহরাম খান কাহিনি অনুকরণ করলেও কবিত্বশক্তি যথেষ্ট সার্থকতা পরিলক্ষিত হয়। ড. আহমদ শরীফের ভাষায় এ কাব্যের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য একে অক্ষয় করেছে। এগুলো হলো :

১.র্সাথক ট্র্যাজেডি       ২. অশ্লীলতামুক্ত       ৩. মানবিকতা        ৪. লোকশ্রুত কাহিনির অনুকৃতি।

বিদ্যাসুন্দুর : সাবিরিদ খান চট্রগ্রামের অধিবাসী। ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য রচনায় কবি প্রচলিত কাহিনি অবলম্বন করেছেন। মানবীয় রস এ কাব্যের স্থান পেয়েছে। বিদ্যা আর সুন্দরের মানবিক প্রেমকাহিনি কবি সুন্দর ভাষায় উপস্থাপন করেছেন।

হানিফা-কয়রাপরি : কবির অন্যতম এ কাব্যটি জঙ্গনামা জাতীয় যুদ্ব কাব্য হলেও প্রেমকাহিনির জন্য তা রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানের পর্যায়ভুক্ত। কাব্যটি খ-িত আকারে পাওয়া গেছে বলে কাব্যটি নিয়ে মতর্পাথক্য রয়েছে। হযরত আলীর পুত্র হানিফা কাহিনির নায়ক, জয়গুনের সঙ্গে হানিফের পরিণয়-যুদ্ধ ইসলাম ধর্ম গ্রহণসহ হানিফার সাথে কয়রাপরীর প্রণয় কাহিনি এ কাব্য বর্ণিত হয়েছে। কাব্যটিতে যুদ্ব থাকলেও প্রণয় কাহিনি সর্পিল গতিতে অগ্রসর হয়ে রোমান্সের পর্যায়ে পৌঁছেছে।

সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল : দোনাগাজী চেীধুরী, আলাওল, ইব্্রাহিম ও মালে মাহমুদ এ প্রেমকাহিনি অবলম্বনে কাব্য রচনা করেছেন। তবে আলাওলের কাব্যই সমধিক পরিচিতি লাভ করেছে। এ কাব্যের আদি উৎস ফারসি ভাষা। ফারসিকাব্য থেকে দোনাগাজী এই গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। রাজপুত্র সয়ফুল রাজকুমারী বদিউজ্জামালের রুপ দেখে প্রেমে আসক্ত হয়। তারপর অনেক বাঁধা অতিক্রম করে তাদের প্রেম বাস্তবে রুপ লাভ করে। সয়ফুল আর বদিউজ্জামালের প্রেম বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছে।

মধুমালতী : মুহম্মদ কবীরের ‘মধুমালতী’ গ্রন্থটি রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ধারায় গুরুত্বপুর্ণ সংযোজন। এ গ্রন্থটি কবে রচিত হয়েছে এ বিষয়ে সুনিদিষ্ট কোন সাল নেই। এ সম্পর্কে প-িতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। হিন্দি কবি মনঝনের কাব্যগ্রন্থ অবলম্বনে মুহম্মদ কবীর এ গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন। মধুমালতী এ কাব্যের নায়িকার নাম। চম্পা নায়িকার বান্ধবী। মনোহর এ কাব্যের নায়ক চরিত্র। মধুমালতী আর মনোহরের প্রেম পাঠককে রোমান্টিকতার জগতে নিয়ে যায়। রুপকথার নায়কের মতো মনোহর সকল বাধা অতিক্রম করে অবশেষে মধুমালতীকে লাভ করে। কবি অসাধারণ কাব্যিক দক্ষতায় এই রোমান্টিক প্রেমকাহিনি পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন।

গুলে-বকাওলী : এই গ্রন্থটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় এ গ্রন্থটি অনুদিত হয়েছে। নওয়াজিস খান এ কাব্যের রচয়িতা। তিনি চট্টগ্রামের অধিবাসী ছিলেন। চট্টগ্রামের এক জমিদারের নির্দেশে তিনি এ কাব্য রনা করেন।

সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী : দৌলত কাজী এ কাব্য রচনা করে বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। এই কাব্যে দুইজন নায়িকা চরিত্র রয়েছে। ময়না ও চন্দ্রানী এ কাব্যের নায়িকা আর লোর হলো জমিদার পুত্র। কাহিনির প্রথম দিকে লোক ময়নাকে বিয়ে দাম্পত্য জীবন শুরু করে। রাজ্যের কাজে একবার লোর অন্যদেশে গমন করে এবং সেখানে রাজকুমারী চন্দ্রানীর সাথে তার পরিচয় হয়। এই দুইজনের মধ্যে প্রেম গড়ে উঠে । অতপর বিয়ের মাধ্যমে তাদের প্রেম সফলতা লাভ করে। ময়নাকে রাজপুত্র ভুলে যায়। তখন ময়নার দুঃখের জীবন শুরু মাত্র। কোন এক সময়ে লোর তার ভুল বুঝতে পারে এবং ময়নার নিকট ফিরে আসে-এই ঘটনা অবলম্বনে সতী ময়না ও লোর চন্দ্রনাী রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান গ্রন্থটি রচিত হয়েছে।

পদ্মাবতী : হিন্দি কবি মালিক মুহম্মদ জায়সীর ‘পদুমাবৎ’ কাব্য অবলম্বনে আলাওল ‘পদ্মাবতী’ কাব্য বাংলায় অনুবাদ করেন। পদ্মাবতী সিংহল দ্বীপের রাজকুমারী। চিতোরের রাজা রত্নসেন শুক পাখির মুখে পদ্মাবতীর রুপের কথা শুনে রাজা রত্নসেন সঙ্গে সঙ্গে ষোলশত কুমারী সঙ্গে নিয়ে সিংহলের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। পথের মধ্যে নানা রকম প্রতিবন্ধিকতা দেখা যায়। রাজা রত্নসেন এ সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে অবশেষে সিংহলে পৌছে এবং রাজকুমারী পদআমাবতীকে বিয়ে করে। বাংলা সাহিত্যে এ রকম রোমান্টিক প্রেম খুব কমই আছে।

উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, মধ্যযুগের একটি বিশেষ ধারা হলো রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান। মধ্যযুগ কবিরা বিভিন্ন ভাষা থেকে অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য ভা-ারকে সমৃদ্ধ করেছেন। নায়ক চরিত্র রুপকথার নায়কের মতোই নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করছে। অবাস্তব ঘটনা ও কল্পকাহিনির জগত পার হয়ে নায়ক এক সময়ে নায়িকার নিকট পৌঁছে নায়িকাকে উদ্ধার করে। কোন একক ব্যক্তি নয়, বরং বিভিন্ন কবি ও সাহিত্যিকদের সামগ্রিক প্রচষ্টায় মধ্যযুগের রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ধারার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ লাভ করেছে। এ রকম সাহিত্য শুধু মধ্যযুগে নয়, বরং সমগ্র বাংলা সাহিত্যেই বিরল।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।

Scroll to Top