Skip to content
Nu Bangla
Menu
  • অনার্স ১ম বর্ষ
    • বাংলাদেশ, বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতি
    • বাংলা ভাষার ইতিহাস ও ব্যবহারিক বাংলা
    • বাংলা কবিতা-১
    • বাংলা উপন্যাস-১
    • স্বাধীন বাংলার অভূদয়ের ইতিহাস
  • অনার্স ২য় বর্ষ
    • বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-১
    • মধ্য যুগের কবিতা
    • বাংলা কবিতা-২
    • বাংলা নাটক-১
  • অনার্স ৩য় বর্ষ
    • বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-২
    • প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিতা
    • বাংলা ছোটগল্প-১
    • ফোকলোরতত্ত্ব ও বাংলা লোকসাহিত্য
    • রূপতত্ত্ব, রসতত্ত্ব, ছন্দ, অলংকার
    • বাংলা প্রবন্ধ-১
    • বাংলা রম্য ও ভ্রমণ সাহিত্য
    • বাংলা উপন্যাস-২
  • অনার্স ৪র্থ বর্ষ
    • বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-৩
    • বাংলা উপন্যাস-৩
    • বাংলা ছোটগল্প-১
    • পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যের সমালোচনা পদ্ধতি
    • অনুবাদে চিরায়িত সাহিত্য
    • বাংলা ছোটগল্প-২
    • বাংলা কবিতা-৩
    • ধ্বনিবিজ্ঞান ও ভাষাতত্ত্ব
    • মৌখিক
  • মাস্টার্স
    • বাংলা কবিতা
    • বাংলা উপন্যাস
    • বাংলা ছোটগল্প
    • বাংলা নাটক
    • বাংলা প্রবন্ধ
    • বাংলাদেশের সাহিত্য
    • ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য
    • মৌখিক
    • টামপেপার
    • এমফিল/পিএইচডি
    • সাজেশন্স
    • চাকরির প্রস্তুতি
    • প্রশ্ন ব্যাংক
Menu
টার্ম পেপার

ত্রিশোত্তর কালের কবি জীবনানন্দ দাশের কাব্য প্রতিভার স্বরপ বিশ্লেষণ। টার্ম পেপার-2

Posted on December 4, 2025 by সালেক শিবলু

বাংলা বিভাগ

এম.এ শেষ বর্ষ

সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা

টার্ম পেপার : ২০১৬

টার্ম পেপার

শিরোনাম : ত্রিশোত্তর কালের কবি জীবনানন্দ দাশের কাব্য প্রতিভার স্বরপ বিশ্লেষণ’

উপস্থাপনায়
মো. সালেকুজ্জামান
বাংলা বিভাগ, এম.এ শেষ বর্ষ
রোল নম্বর : ১৩০০১
শিক্ষাবর্ষ: ২০১৩-১৪
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা
তত্ত্বাবধায়ক
জনাব মো. আমজাদ
সহযোগী অধ্যাপক
বাংলা বিভাগ
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা

মুখবন্ধ

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক মৌলিক ও বিস্ময়কর, সৃজন প্রতিভার অধিকারী ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ । তাঁর মতো মনে-প্রাণে চিন্তায় কর্মে, দুঃখে সুখে জীবন মরণে সমদৃষ্টিমান জীবন ভাবনা কবি ইতিহাসে আর দেখা যায় না। বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাত হয়েছিল তিরিশের দশকে আর এই আধুনিকতার সাঁকোটি যারা সযত্নে নির্মাণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম কবি জীবনানন্দ দাশ । শুধু কবিতা লেখাকেই জীবনের অন্যতম সংগ্রাম হিসেবে নিয়েছিলেন। ইউরোপীয় কবিতার নির্যাস আর বাংলার শ্যামল মাটির গন্ধ মিশিয়ে তিনি যে কবিতা-সংসারের গোড়াপত্তন করেছিলেন,  সেই গেরস্থালির উত্তরাধিকার আজকের আমরা যারা কবিতার নতুন জল-ভূমির সন্ধানে মরিয়া, তাদের সামনে রৌদ্রকরোজ্জ্বল যে-সাঁকোটি নির্ভার রহস্যের ঢেউ তুলে কথা বলতে চায়, তার দিকে আমাদের তাকাতেই হয়। সাঁকোটিতে রং-রস-রূপের মাধুর্যে এই শুদ্ধতম কবির শিল্পীসত্তার অহংকার মিশে আছে নিবিড় মমতায়।
তাই ‘ ত্রিশোত্তর কালের কবি জীবনানন্দ দাশের কাব্য প্রতিভার স্বরপ বিশ্লেষণ’ বিষয়টি বাংলা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট গবেষণা  হওয়ার দাবি রাখে । এর অংশ হিসেবে এম.এ শেষ বর্ষের পাঠ্যসূচির অর্š—ভূক্ত টার্ম পেপার প্রস্তুত কর্মটি একটি ক্ষুদ্র গবেষণা হলেও বাংলা বিভাগের প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে চিহ্নিত। টার্ম পেপার গবেষণার জন্য আমার নির্ধারিত বিষয় হলো ‘ত্রিশোত্তর কালের কবি জীবনানন্দ দাশের কাব্য প্রতিভার স্বরপ বিশ্লেষণ কর ’ এই গবেষণা কর্মটি ধারাবাহিকতা বা যথার্থতার প্রশ্নে কতটা উত্তীর্ণ হয়েছে বা হয়নি তার চেয়ে  বড় কথা গবেষণার মাধ্যমে ত্রিশোত্তর কালের কবি জীবনানন্দ দাশের কাব্য প্রতিভার স্বরপ খুঁজে পেয়েছি।  তবুও সকল দিক বিবেচনা করলে গবেষণা কর্মটি যথাযোগ্য মূল্যায়ন হবে বলে আমার বিশ্বাস।
মো. রুবেল হোসেন
বাংলা বিভাগ, এম.এ. শেষ বর্ষ
রোল নম্বর : ১৪০৪১
শিক্ষাবর্ষ: ২০১৪-১৫
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা

অনুমোদনপত্র

মো. রুবেল হোসেন কর্তৃক ‘ত্রিশোত্তর কালের কবি জীবনানন্দ দাশের কাব্য প্রতিভার স্বরপ বিশ্লেষণ কর’ শীর্ষক গবেষণাপত্রটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ. শেষ বর্ষের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পাঠ্যক্রমের সম্পূরক হিসেবে অনুমোদন করা হল ।
তত্ত্বাবধায়ক
ড. মো. আবদুল মজিদ
সহযোগী অধ্যাপক
বাংলা বিভাগ
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা

সূচিপত্র
১. ভূমিকা
২. পরিচয়
৩. শিক্ষাজীবন
৪. সাহিত্যচর্চা ও জীবনসংগ্রাম :
৫. জীবনানন্দ দাশের কাব্যপ্রতিভা
৬. সার-সংক্ষেপ :
৭. সহায়ক গ্রন্থ

ভূমিকা
জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যের আকাশে এক উজ্জ্বল প্রতিভার নাম। আধুনিক বাংলা কবিতা যখন প্রায় সর্বাংসে রবীন্দ্রময়, ঠিক তখনই এক অভিনব আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে বাংলা কাব্যের জগতে প্রবেশ করলেন জীবনানন্দ দাশ। তিনি যে একজন আধুনিক কবি, এ নিয়ে আর তর্ক নেই।  পশ্চিমা মডার্নিস্ট মুভমেন্টের আলোকে ভাবতে গেলে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাত হয়েছিল তিরিশের দশকে। এই আধুনিকতার সাঁকোটি যারা সযত্নে নির্মাণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম কবি জীবনানন্দ দাশ শুধু কবিতা লেখাকেই জীবনের অন্যতম সংগ্রাম হিসেবে নিয়েছিলেন। ইউরোপীয় কবিতার নির্যাস আর বাংলার শ্যামল মাটির গন্ধ মিশিয়ে তিনি যে কবিতা-সংসারের গোড়াপত্তন করেছিলেন।
কবিতার চঞ্চলা হরিণী ধরা দিয়েছিল তাঁর কাছে কোনো এক পৌষ-সন্ধ্যায়, তিনি বুঝেছিলেন ‘ সে যেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা হয়।’ অন্ধকারের যোনির ভেতরে তিনি সৃষ্টির অপার সম্ভাবনাকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। প্রকৃতির নিবিড় অবলোকনের ক্ষমতা তিনি পেয়েছিলেন তার অন্তর্গত বিষাদ থেকে। অনেক ভেতরে খুঁড়ে খুঁড়ে সংগ্রহ করেছিলেন কবিতার আকর,মণি-মুক্তো, কৈবল্যের উড়ন্ত পত্রালি। তাঁর কবিতার অন্তরালে যে গানের দীপাবলি মনকে অন্যভাবে আবিষ্ট করে, সেখানেও আমাদের দাঁড়াতে হয়, ভাবতে হয় এই নির্জনতম কবির প্রজ্বলিত হৃদয়ের অভিজ্ঞান কীভাবে কালিক সত্যকে বহন করে বয়ে যায় কালান্তরে।
এজরা পাউন্ড কবিদের বলেছিলেন ‘জাতির অ্যান্টেনা’। তিনি বিশ শতকের কবিতা-আন্দোলনের প্রধান পুরুষ, যিনি খাঁটি কবিতার পক্ষেই ওকালতি করেছেন সারাটা জীবন। জীবনানন্দ দাশ সেই খাঁটি কবি, যাঁকে আমরা বাংলা আধুনিক কবিতার প্রধান রূপকার বললে তাতে কোনো অত্যুক্তি হবে না। তাঁকে কবিদের কবিও বলা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের পরে তিনিই সবচেয়ে বড় কবি এবং তিরিশি কবিদের মধ্যে তাঁর কবিতাই বহুলপঠিত ও নন্দিত। বর্তমানে যাঁরা বাংলা কবিতার প্রধান কবি হিসেবে পরিচিত, তাঁদের সবাই জীবনানন্দ দ্বারা প্রাথমিকভাবে প্রভাবিত ছিলেন এবং সে-প্রভাব কাটিয়ে উঠতে অনেককেই অনেক পথ হাঁটতে হয়েছে এবং অনেক বড় কবির কবিতায় আজো বয়ে গেছে জীবনানন্দীয় আবহ কোনো-না-কোনোভাবে। শামসুর রাহমান, শঙ্খ ঘোষ এবং উৎপলকুমার বসু থেকে শুরু করে অন্যরা, পঞ্চাশ-ষাটের সব কবিই বলতে গেলে, জীবনানন্দের জগৎ হয়েই নতুন কবিতার পথ নির্মাণ করেছেন, আবার কেউ কেউ সে-চেষ্টায় আজো অবিরাম পথ কেটে চলেছেন নিরলসভাবে এবং এ-কথা সত্য যে, জীবনানন্দ-মুক্তি আজ কবি হয়ে-ওঠার অন্যতম প্রধান শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ তাঁর কবিতাপাঠ আমাদের অস্তিত্বের   অন্তর্তল এমনভাবে স্পর্শ করে যে, তা হয়ে ওঠে অস্তিত্বের অনিবার্য পাঠ।
তিরিশি কবিদের মধ্যে তিনিই একমাত্র কবি, যাঁকে প্রথম জীবনে অনেক ধকল সহ্য করতে হয়েছে সম্পূর্ণ নতুন কবিতা লেখার অপরাধে। একমাত্র বুদ্ধদেব বসুই বুঝেছিলেন বাংলা কবিতায় একজন  প্রোফেটের আগমন ঘটেছে এবং তিনিই সর্বপ্রথম সবাইকে জানিয়ে দিলেন জীবনানন্দ দাশই ‘খাঁটি আধুনিক’ কবি।
এ-কথা সবারই জানা যে, বুদ্ধদে বসুর আগে তাঁকে নিয়ে বা তাঁর কবিতা নিয়ে কেউ কোনো প্রশংসার বাণীতো দূরের কথা, তাঁর সহকর্মীরা পর্যন্ত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন। এমনকি সুধীন দত্তের মতো কবিও তাঁর পত্রিকায় জীবনানন্দ দাশের কবিতা না ছেপে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এসবের কারণ হলো, তিনি ছিলেন দূরবর্তী সময়ের সচেতন কবিব্যক্তিত্ব। তাঁর সময়ের সেই জনপ্রিয় কবি-পুরোহিতদের কেউ কেউ কবেই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন, বেঁচে আছেন তিনি আজো সাবলীল অহংকারে কবিতার বরপুত্র হিসেবে।
তিনি চর্যাপদ থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এবং বাঙালির হাজার বছরেরও বেশি সময়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-ইতিহাসকে আত্মস্থ করেছিলেন নিমগ্ন সাহসে এবং পাশ্চাত্য শিল্প-সাহিত্য-দর্শন-নন্দনতত্ত্বের নানাবিধ অনুষঙ্গের অন্তর্গত নির্যাসও তিনি পান করেছেন সৃজনতেষ্টায় এবং তার সবটুকু জীবনকে তিনি ঢেলে দিয়েছিলেন কবিতার পাত্রে, যা আমরা পান করছি  গন্ডূষে গন্ডূষে এবং অনাগতকালের কবিরাও করবে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ তিনি ‘সময়োত্তর’ কবি; কবিতা ও জীবনকে তিনি একাকার করে ফেলেছিলেন এবং জীবনকে মন্থন করে কবিতা-অমৃত দিয়ে গেছেন আমাদের। তাঁর অস্থিমজ্জার জারকরসে নির্মিত বিশাল সঞ্চয়ই বাংলা কবিতার কালসঞ্চারী আলো, যার মধ্যে দিয়ে আমরা দেখতে পাই আমাদের চিরায়ত বাঙালিসত্তার বিচিত্র বৈভব।

পরিচয় :
জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির     অন্তর্গত বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণা নিবাসী। তাঁর পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৩৮-৮৫) বিক্রমপুর থেকে       স্থানান্তরক্রমে বরিশালে নিবাস গড়েন। সর্বানন্দ দাশগুপ্ত জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন; পরে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষানেন। তিনি বরিশালে ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁর মানবহিতৈষী কাজের জন্যে ব্যাপকভাবে সমাদৃত ছিলেন। জীবনানন্দের পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত সর্বানন্দের দ্বিতীয় পুত্র। সত্যানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৬৩-১৯৪২) ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক।
জীবনানন্দের মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন গৃহস্থ, কিন্তু তিনি কবিতা লিখতেন। তাঁর সুপরিচিত কবিতা আদর্শ ছেলে (আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে) আজও শিশুশ্রেণির পাঠ্য। জীবনানন্দ ছিলেন পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান; তার ডাকনাম ছিল মিলু। তার ভাই অশোকানন্দ দাশ ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে এবং বোন সুচরিতা দাশ ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কম বয়সে স্কুলে ভর্তি হওয়ার বিরোধী ছিলেন ব’লে বাড়িতে মায়ের কাছেই মিলুর বাল্যশিক্ষার সূত্রপাত। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই পিতার কণ্ঠে উপনিষদ আবৃত্তি ও মায়ের গান শুনতেন। লাজুক স্বভাবের হলেও তার খেলাধুলা, বাগান করা, ভ্রমণ ও সাঁতারের অভ্যাস ছিল। ছেলেবেলায় মামার সঙ্গে বহু জায়গায়  বেড়িয়েছেন। শৈশবে একবার কঠিন অসুখে পড়েন। স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্যে মাতা ও মাতামহ হাসির গানের কবি চন্দ্রনাথের সাথে লক্ষ্মৌ, আগ্রা, দিল্লী প্রভৃতি স্থান ভ্রমণ করেন।
জন্মসূত্রে তাঁর পদবী “দাশগুপ্ত” হলেও তিরিশের দশকের শুরুতে জীবনানন্দ “গুপ্ত” বর্জন করে কেবল দাশ  লেখা শুরু করেন।
শিক্ষাজীবন :
জীবনানন্দ দাশের গরোয়া নাম ছিল মিলু। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে আট বছরের মিলুকে ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। বিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়েই তাঁর বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় রচনার সূচনা হয়। এছাড়াও সে সময় ছবি আঁকার দিকেও ঝোঁক ছিল। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকিউলেশন (বর্তমানে মাধ্যমিক বা এসএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। দু’বছর পর ব্রজমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট (উচ্চ মাধ্যমিক) পরীক্ষায় পূর্বের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি ঘটান; অতঃপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার উদ্দেশ্যে বরিশাল ত্যাগ করেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স সহ বিএ ডিগ্রী লাভ করেন। অতঃপর ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি আইন পড়া শুরু করেন, কিন্তু অচিরেই তা পরিত্যাগ করেন।

সাহিত্যচর্চা ও জীবনসংগ্রাম :
যৌবনের প্রারম্ভেই জীবনানন্দের কবি প্রতিভা বিকশিত হতে শুরু করে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৫ এর জুনে মৃত্যুবরণ করলে জীবনানন্দ তাঁর স্মরণে ‘দেশবন্ধুর প্রয়াণে’ নামক একটি কবিতাব্রাহ্মবাদী রচনা করেন, যা বঙ্গবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবিতাটি পরবর্তীতে তার প্রথম কাব্য সংকলন ঝরা পালকে স্থান করে নেয়। কবিতাটি পড়ে কবি কালিদাস রায় মন্তব্য করেছিলেন, “এ ব্রাহ্মবাদী কবিতাটি নিশ্চয়ই কোন প্রতিষ্ঠিত কবির ছদ্মনামে রচনা”। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দেই তার প্রথম প্রবন্ধ স্বর্গীয় কালীমোহন দাশের শ্রাদ্ধবাসরে প্রবন্ধটি ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার পরপর তিনটি সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ঐ বছরেই কল্লোল পত্রিকায় ‘নীলিমা’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে তা অনেক তরুণ কাব্যরসিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ধীরে ধীরে কলকাতা, ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতে থাকে; যার মধ্যে ছিল সে সময়কার সুবিখ্যাত পত্রিকা কল্লোল, কালি ও কলম, প্রগতি প্রভৃতি। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালক প্রকাশিত হয়। সে সময় থেকেই তিনি তার পারিবারিক উপাধি ‘দাশগুপ্তের’ বদলে কেবল ‘দাশ’ লিখতে শুরু করেন।
প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কয়েক মাসের মাথাতেই তিনি সিটি কলেজে তার চাকরিটি হারান। ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে কলেজটিতে ছাত্র অসন্তোষ দেখা দেয়, ফলাফলস্বরূপ কলেজটির ছাত্রভর্তির হার আশঙ্কাজনকহারে কমে যায়। জীবনানন্দ ছিলেন কলেজটির শিক্ষকদের মধ্যে কনিষ্ঠতম এবং আর্থিক সমস্যাগ্রস্ত কলেজ প্রথমে তাকেই চাকরিচ্যুত করে। এই চাকুরিচ্যুতি দীর্ঘকাল জীবনানন্দের মনোবেদনার কারণ ছিল। কলকাতার সাহিত্যচক্রেও সে সময় তার কবিতা কঠিন সমালোচনার মুখোমুখি হয়।  সে সময়কার প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক কবি-সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস শনিবারের চিঠি পত্রিকায় তার রচনার নির্দয় সমালোচনায় প্রবৃত্ত হন। কলকাতায় করবার মতোন কোন কাজ ছিল না বিধায় কবি ছোট্ট শহর বাগেরহাটের প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তবে মাত্র দুই মাস কুড়ি দিন পরেই তিনি কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় তিনি প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ে থাকতেন। চাকুরি না-থাকায় এ সময় তিনি চরম আর্থিক দুর্দশায় পড়ে গিয়েছিলেন। জীবনধারণের জন্যে তিনি টিউশানি করতেন এবং লেখালিখি থেকে সামান্য কিছু রোজগার হতো। সাথে সাথে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরির সন্ধান করছিলেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে তিনি দিল্লির রামযশ কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। এখানেও তাঁর চাকুরীর মেয়াদ মাত্র চার মাস।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৯ই মে তারিখে তিনি লাবণ্য দেবীর সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ে হয়েছিলো ঢাকায় শহরে, পুরোনো ঢাকায় সদরঘাট সংলগ্ন ব্রাহ্ম সমাজের রামমোহন লাইব্রেরিতে। লাবণ্য গুপ্ত সে সময় ঢাকার ইডেন কলেজে লেখা-পড়া করছিলেন। জীবনানন্দ দাশের বিয়েতে কবি বুদ্ধদেব বসু, অজিতকুমার দত্ত প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বিয়ের পর আর দিল্লিতে ফিরে যান নি। এরপর প্রায় বছর পাঁচেক সময় জীবনানন্দ কর্মহীন অবস্থায় ছিলেন। মাঝে কিছু দিন একটি বীমা কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন;  ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে অর্থ ধার করে ব্যবসায় করেছেন; কিন্তু কোনটাই স্থায়ী হয়নি। এসময় তাঁর পিতা জীবিত এবং জীবনান্দের স্ত্রী বরিশালেই ছিলেন বলে জীবনানন্দের  বেকারত্ব পারিবারিক দুরবস্থার কারণ হয় নি।
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে কবির প্রথম সন্তান মঞ্জুশ্রীর জন্ম হয়। প্রায় সে সময়েই তার ক্যাম্পে কবিতাটি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং সাথে সাথে তা কলকাতার সাহিত্যসমাজে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়। কবিতাটির আপাত বিষয়বস্তু ছিল জোছনা রাতে হরিণ শিকার। অনেকেই এই কবিতাটি পাঠ করে তা অশ্লীল হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি তার  বেকারত্ব, সংগ্রাম ও হতাশার এই সময়কালে বেশ কিছু ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছিলেন;- তবে তার জীবদ্দশায় সেগুলো প্রকাশিত করেন নি। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি একগুচ্ছ গীতিকবিতা রচনা করেন যা পরবর্তী কালে তাঁর রূপসী বাংলা কাব্যের প্রধান অংশ নির্মাণ করে। জীবনানন্দ এ কবিতাগুলো প্রকাশ করেননি এবং ১৯৫৪-তে তার মৃত্যুর পর কবিতাগুলো একত্র করে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন বোন সুচরিতা দাশ এবং ময়ুখ পত্রিকা খ্যাত কবি ভূমেন্দ্র গুহ।
১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে জীবনানন্দ তার পুরনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্রজমোহন কলেজে ফিরে যান, যা তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। তিনি সেখানকার ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। সে সময়ে কলকাতায় বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং সমর সেন একটি আনকোড়া নতুন কবিতাপত্রিকা বের করার তোড়জোড় করছিলেন, যার নাম দেয়া হয় কবিতা। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যাতেই জীবনানন্দের একটি কবিতা স্থান করে নেয়, যার নাম ছিল ‘মৃত্যুর আগে’। কবিতাটি পাঠ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুদ্ধদেবকে লেখা একটি চিঠিতে মন্তব্য করেন কবিতাটি ‘চিত্ররূপময়’। কবিতা পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যাতে (পৌষ ১৩৪২ সংখ্যা; ডিসে ১৯৩৪/জানু ১৯৩৫) তার কিংবদন্তিতুল্য বনলতা সেন কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এই ১৮ লাইনের কবিতাটি বর্তমানে বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতার অন্যতম হিসেবে বিবেচিত। পরের বছর জীবনানন্দের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ধূসর পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হয়। জীবনানন্দ এর মধ্যেই বরিশালে সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিলেন। ১৯৩৬ এর নভেম্বরে তার পুত্র সমরানন্দের জন্ম হয়। ১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথ একটি কবিতা সংকলন সম্পাদনা করেন, যার নাম ছিল বাংলা কাব্য পরিচয় এবং এতে জীবনানন্দের মৃত্যুর আগে কবিতাটি স্থান পায়। ১৯৩৯ সালে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয় আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হিরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়; এতে জীবনানন্দের চারটি কবিতা – পাখিরা, শকুন, বনলতা সেন এবং নগ্ন নির্জন হাত অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪২ সালে কবির পিতৃবিয়োগ হয় এবং ঐ বছরেই তার তৃতীয় কবিতাগ্রন্থ বনলতা সেন প্রকাশিত হয়। বইটি বুদ্ধদেব বসুর কবিতা-ভবন হতে ‘এক পয়সায় একটি’ সিরিজের অংশ হিসেবে প্রকাশিত হয় এবং এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ষোল। বুদ্ধদেব বসু ছিলেন জীবনানন্দের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক এবং তার সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় জীবনানন্দের বহু সংখ্যক কবিতা ছাপা হয়। ১৯৪৪ সালে তার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ মহাপৃথিবী প্রকাশিত হয়। এর আগের তিনটি কাব্যগ্রন্থ তাকে নিজের পয়সায় প্রকাশ করতে হয়েছিল, তবে মহাপৃথিবীর জন্যে প্রকাশক পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে প্রকাশিত এই কবিতাগুচ্ছে যুদ্ধের ছাপ স্পষ্ট।
চাকরির প্রয়োজনে বরিশালে প্রত্যাবর্তন করলেও কলকাতা জীবনানন্দকে খুব টানতো। কলকাতার সুপরিসর বিস্তৃতি তিনি উপভোগ করতেন। তিনি সর্বদাই কলকাতায় অভিবাসনের কথা ভাবতেন। সুযোগ পেলেই স্টিমারে বরিশাল থেকে খুলনা তারপর ট্রেনে বেনাপোল হয়ে কলকাতায় পাড়ি জমাতেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠে। জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের জন্যে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানান। এর ফলে বাংলা দ্বিখণ্ডিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে, কারণ এর পূর্ব অংশ ছিল মুসলমান সংখ্যাপ্রধান আর পশ্চিমাংশে হিন্দুরা ছিল সংখ্যাগুরু। ১৯৪৭ এর দেশভাগ পূর্ববর্তী ঐ সময়টিতে বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিভৎসরূপে দেখা দেয়। জীবনানন্দ সব সময়ই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সপক্ষে সোচ্চার ছিলেন। কলকাতায় যখন ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে আবার হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে কবি তখন লেখেন ১৯৪৬-৪৭ কবিতাটি। দেশবিভাগের কিছু আগে তিনি বি.এম. কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন। ছুটি বাড়িয়ে কলকাতায় দীর্ঘ কয়েক মাস অবস্থান করেছেন। এর পর পূর্ববঙ্গে এসেছেন কিন্তু তা ছিল সাময়িক। ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের কিছু পূর্বে সপরিবারে বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেন এবং কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। কলকাতায় তিনি ”দৈনিক স্বরাজ” পত্রিকার রোববারের সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনা করেন। কিন্তু এই চাকুরির স্থায়ীত্ব ছিল ছিল মাত্র সাত মাস। কাজী নজরুল ইসলাম বিষয়ক একটি গদ্য রচনা মালিক পক্ষের মনঃপুত না-হওয়ায় এই চাকুরিচ্যূতি।
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ তিনি আরো দু’টি উপন্যাস লিখেছিলেন – ”মাল্যবান” ও ”সুতীর্থ”, তবে আগেরগুলোর মতো এ দুটিও অপ্রকাশিত রেখেছেন। এ বছরের ডিসেম্বরে তাঁর পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ সাতটি তারার তিমির প্রকাশিত হয়। একই মাসে কলকাতায় তার মাতা কুসুমকুমারী দাশের জীবনাবসান ঘটে।
ইতোমধ্যেই জীবনানন্দ কলকাতার সাহিত্যিক সমাজে নিজস্ব একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন। তিনি ‘সমকালীন সাহিত্যকেন্দ্র’ নামে একটি সংস্থার সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন এবং এই সংস্থার মুখপত্র দ্বন্দ্ব পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক নিযুক্ত হন। মাঝে তিনি কিছুকাল খড়গপুর কলেজে অধ্যাপনা করেন।
 ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জনপ্রিয় কবিতার বই বনলতা সেন সিগনেট প্রেস কর্তৃক পরিবর্ধিত আকারে প্রকাশিত হয়। বইটি পাঠকানুকূল্য লাভ করে এবং নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন-কর্তৃক ঘোষিত “রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরস্কার” জয় করে। মৃত্যুর কিছু পূর্বে হাওড়া গার্লস কলেজ-এ অধ্যাপনার চাকুরি জুটে গেলে তাঁর কলকাতা জীবনের অপরিসীম দৈন্যদশার সুরাহা হয়। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর (২৪ অগ্রহায়ণ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ) ঠাকুরবাড়ির অধস্তন কর্মচারী বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিবাহিত জীবনে ভবতারিণীর নামকরণ হয়েছিল মৃণালিনী দেবী (১৮৭৩-১৯০২ )। রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনীর সন্তান ছিলেন পাঁচ জন: মাধুরীলতা (১৮৮৬-১৯১৮), রথীন্দ্রনাথ (১৮৮৮-১৯৬১), রেণুকা (১৮৯১-১৯০৩), মীরা (১৮৯৪-১৯৬৯) এবং শমীন্দ্রনাথ (১৮৯৬-১৯০৭)। এঁদের মধ্যে অতি অল্প বয়সেই রেণুকা ও শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু ঘটে।
 ১৮৯১ সাল থেকে পিতার আদেশে নদিয়া (নদিয়ার উক্ত অংশটি অধুনা বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা), পাবনা ও রাজশাহী জেলা এবং উড়িষ্যার জমিদারিগুলির তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছিলেন। জমিদার রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে “পদ্মা” নামে একটি বিলাসবহুল পারিবারিক বজরায় চড়ে প্রজাবর্গের কাছে খাজনা আদায় ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে যেতেন। গ্রামবাসীরাও তাঁর সম্মানে ভোজসভার আয়োজন করত।
১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে শিলাইদহ ছেড়ে চলে আসেন বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের উপকণ্ঠে শান্তিনিকেতনে। এখানে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৮ সালে একটি আশ্রম ও ১৮৯১ সালে একটি ব্রহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আশ্রমের আম্রকুঞ্জ উদ্যানে একটি গ্রন্থাগার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চালু করলেন “ব্রহ্মবিদ্যালয়” বা “ব্রহ্মচর্যাশ্র” নামে একটি পরীক্ষামূলক স্কুল। ১৯০২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী মারা যান।
এরপর ১৯০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কন্যা রেণুকা, ১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ১৯০৭ সালের ২৩ নভেম্বর কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। এসবের মধ্যেই ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠান আধুনিক কৃষি ও গোপালন বিদ্যা শেখার জন্য। ১৯০৭ সালে কনিষ্ঠা জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কেও কৃষিবিজ্ঞান শেখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
এই সময় শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ে অর্থসংকট তীব্র হয়ে ওঠে। পাশাপাশি পুত্র ও জামাতার বিদেশে পড়াশোনার ব্যয়ভারও রবীন্দ্রনাথকে বহন করতে হয়। এমতাবস্থায় রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীর গয়না ও পুরীর বসতবাড়িটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন।
ইতোমধ্যেই অবশ্য বাংলা ও বহির্বঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯০১ সালে নৈবেদ্য ও ১৯০৬ সালে খেয়া কাব্যগ্রন্থের পর ১৯১০ সালে তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি (ইংরেজি অনুবাদ, ১৯১২) কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য সুইডিশ অ্যাকাডেমি রবীন্দ্রনাথকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘স্যার’ উপাধি (নাইটহুড) দেয়।
১৯২১ সালে শান্তিনিকেতনের অদূরে সুরুল গ্রামে মার্কিন কৃষি-অর্থনীতিবিদ লেনার্ড নাইট এলমহার্স্ট, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শান্তিনিকেতনের আরও কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্রের সহায়তায় রবীন্দ্রনাথ “পল্লীসংগঠন কেন্দ্র” নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল কৃষির উন্নতিসাধন, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগ নিবারণ, সমবায় প্রথায় ধর্মগোলা স্থাপন, চিকিৎসার সুব্যবস্থা এবং সাধারণ গ্রামবাসীদের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি করা। ১৯২৩ সালে রবীন্দ্রনাথ এই সংস্থার নাম পরিবর্তন করে রাখেন “শ্রীনিকেতন“। শ্রীনিকেতন ছিল মহাত্মা গান্ধীর প্রতীক ও প্রতিবাদসর্বস্ব স্বরাজ আন্দোলনের একটি বিকল্প ব্যবস্থা। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীর আন্দোলনের পন্থা-বিরোধী ছিলেন। পরবর্তীকালে দেশ ও বিদেশের একাধিক বিশেষজ্ঞ, দাতা ও অন্যান্য পদাধিকারীরা শ্রীনিকেতনের জন্য আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য পাঠিয়েছিলেন।
১৯৩০-এর দশকের প্রথম ভাগে একাধিক বক্তৃতা, গান ও কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সমাজের বর্ণাশ্রম প্রথা ও অস্পৃশ্যতার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি :
নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে পরিবর্ধিত সিগনেট সংস্করণ বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থটি বাংলা ১৩৫৯-এর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ বিবেচনায় পুরস্কৃত করা হয়। কবির মৃত্যুর পর ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৪) সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করে।
মৃত্যু :
১৪ই অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় তিনি আহত হন। ট্রামের ক্যাচারে আটকে তার শরীর দলিত হয়ে গিয়েছিল। ভেঙ্গে গিয়েছিল কণ্ঠা, ঊরু এবং পাঁজরের হাড়।

ত্রিশোত্তর কালের কবি জীবনানন্দ দাশের কাব্যপ্রতিভা
কবি জীবনানন্দ সম্ভবত মা কুসুমকুমারী দাশের প্রভাবেই ছেলেবেলায় কবিতা লিখতে শুরু করেন তিনি। ১৯১৯ সালে তাঁর লেখা একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা। কবিতাটির নাম বর্ষা আবাহন। এটি ব্রহ্মবাদী পত্রিকার ১৩২৬ সনের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। তখন তিনি শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত নামে লিখতেন। ১৯২৭ সাল থেকে তিনি জীবনানন্দ দাশ নামে লিখতে শুরু করেন। ১৬ জুন ১৯২৫ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এর লোকান্তর হলে তিনি ‘দেশবন্ধুর প্রয়াণে’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন যা বংগবাণী পত্রিকার ১৩৩২ সনের শ্রাবণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তবে দীনেশরঞ্জন দাস সম্পাদিত কল্লোল পত্রিকায় ১৩৩২ (১৯২৬ খ্রি.) ফাল্গুন সংখ্যায় তাঁর নীলিমা শীর্ষক কবিতাটি প্রকাশিত হলে আধুনিক বাংলা কবিতার ভুবনে তার অন্নপ্রাশন হয়। জীবদ্দশায় তাঁর ৭টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। প্রথম প্রকাশিত ঝরাপালক শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে তাঁর প্রকৃত কবিত্বশক্তি ফুটে ওঠেনি, বরং এতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রকট প্রভাব প্রত্যক্ষ হয়। তবে দ্রুত তিনি স্বকীয়তা অর্জন করেছিলেন। দীর্ঘ ব্যবধানে প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্য সংকলন ধূসর পাণ্ডুলিপি-তে তাঁর স্বকীয় কাব্য কৌশল পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। বাংলা সাহিত্যের ভূবনে তাঁর বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। শেষের দিককার কবিতায় অর্থনির্মলতার অভাব ছিল। সাতটি তারার তিমির প্রকাশিত হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুবোর্ধ্যতার অভিযোগ ওঠে। নিজ কবিতার অবমূল্যায়ন নিয়ে জীবনানন্দ খুব ভাবিত ছিলেন। তিনি নিজেই স্বীয় রচনার অর্থায়ন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন যদিও শেষাবধি তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে কবি নিজেই নিজ রচনার কড়া সমালোচক ছিলেন। তাই সাড়ে আট শত কবিতার বেশি কবিতা লিখলেও তিনি জীবদ্দশায় মাত্র ২৬২টি কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও কাব্যসংকলনে প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন। এমনকি রূপসী বাংলার সম্পূর্ণ প্রস্তুত পাণ্ডুলিপি তোরঙ্গে মজুদ থাকলেও তা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি জীবনানন্দ দাশ। তবে তিনি এ কাব্যগ্রন্থটির নাম দিয়েছিলেন বাংলার ত্রস্ত নীলিমা যা তার মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত এবং রূপসী বাংলা প্রচ্ছদনামে প্রকাশিত হয়। আরেকটি পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয় মৃত্যু পরবর্তীকালে যা বেলা অবেলা কালবেলা নামে প্রকাশিত হয়। জীবদ্দশায় তার একমাত্র পরিচয় ছিল কবি।
জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ :
জীবনানন্দের কাব্যগ্রন্থসমূহের প্রকাশকাল সম্পর্কে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের একাধিক পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। নিচে কেবল প্রথম প্রকাশনার বৎসর উল্লিখিত। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে। এর দীর্ঘ কাল পর ১৯৩৬-এ প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’। ইত্যবসরে কবির মনোজগতে যেমন পরিবর্তন হয়েছে তেমনি রচনাকৌশলও অর্জন করেছে সংহতি এবং পরিপক্বতা। তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বনলতা সেন’ প্রকাশিত হয় ১৯৪২-এ। এটি “কবিতাভবন সংস্করণ” নামে অভিহিত। সিগনেট প্রেস ‘বনলতা সেন’ প্রকাশ করে ১৯৫২-তে। ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাসমূহ সহ পরবর্তী কবিতাগ্রন্থ ‘মহাপৃথিবী’ ১৯৪৪-এ প্রকাশিত। জীবনানন্দর জীবদ্দশায় সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘সাতটি তারার তিমির ’(১৯৪৮)। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর কিছু আগে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা।
কবির মৃত্যু-পরবর্তী প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ হলো ১৯৫৭-তে প্রকাশিত ‘রূপসী বাংলা’ এবং ১৯৬১-তে প্রকাশিত ‘বেলা অবেলা কালবেলা’। জীবনানন্দ দাশ ‘রূপসী বাংলা’’র পাণ্ডুলিপি তৈরি করে থাকলেও জীবদ্দশায় এর প্রকাশের উদ্যোগ নেন নি। তিনি গ্রন্থটির প্রচ্ছদ নাম নির্ধারণ করেছিলেন বাংলার ‘ত্রস্ত নীলিমা’। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশকালে এর নামকরণ করা হয় “রূপসী বাংলা।” তাঁর অগ্রন্থিত কবিতাবলী নিয়ে প্রকাশিত কবিতা সংকলনগুলো হলো: ‘সুদর্শনা’ (১৯৭৩), ‘আলো পৃথিবী’ (১৯৮১), মনোবিহঙ্গম, হে প্রেম তোমার কথা ভেবে (১৯৯৮), অপ্রকাশিত একান্ন (১৯৯৯) এবং আবছায়া (২০০৪)।
জীবনানন্দ দাশের কাব্যপ্রতিভা :
জীবনানন্দ দাশ কেবলই কবি হতে চেয়েছিলেন, এক নক্ষত্রবিম্বিত জলাশয় হতে  চেয়েছিলেন, আর কিছু নয়; এই সত্যটা বুঝে উঠতে পারলে কোনো কবিতা-যাত্রিকের কাছে কবিতা-দেবীর সাক্ষাৎ পাওয়াটা সহজতর হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার কবি হওয়ার সহজ কোনো পথ নেই, কবিতার শরীরে তাই দেখা যায় কবির কতশত রক্ত-মাংসের ঝাঁঝালো দুপুর, মৃত্যুর গোধূলিলগ্ন মৌন অন্ধকার আর রাশি রাশি ফেনায়িত আহত সত্ত্বার সংগ্রাম। কবি-হতে-চাওয়া কোনো কিশোর-বালকের জন্য এ-কথা সুখের নয় যদিও, এই সত্য মেনে নিতে হবে; মনে রাখতে হবে কবিতা-দেবী খুব অল্পতে  সুপ্রসন্ন হন না। তাই কবিতার সংগ্রাম আর জীবনের সংগ্রামকে আলাদা করে দেখার কোনো উপায় নেই আজ আর। এই সংগ্রামে জয়ী হতে হলে নির্মম প্রার্থনায় নত হতে হবে, স্পর্শ করতে হবে কবিতার সর্বগ্রাসী সত্যকে।
পশ্চিমা মডার্নিস্ট মুভমেন্টের আলোকে ভাবতে গেলে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাত হয়েছিল তিরিশের দশকে। এই আধুনিকতার সাঁকোটি যারা সযত্নে নির্মাণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম কবি জীবনানন্দ দাশ শুধু কবিতা লেখাকেই জীবনের অন্যতম সংগ্রাম হিসেবে নিয়েছিলেন। ইউরোপীয় কবিতার নির্যাস আর বাংলার শ্যামল মাটির গন্ধ মিশিয়ে তিনি যে কবিতা-সংসারের গোড়াপত্তন করেছিলেন, সেই গেরস্থালির উত্তরাধিকার আজকের আমরা যারা কবিতার নতুন জল-ভূমির সন্ধানে মরিয়া, তাদের সামনে রৌদ্রকরোজ্জ্বল যে-সাঁকোটি নির্ভার রহস্যের ঢেউ তুলে কথা বলতে চায়, তার দিকে আমাদের তাকাতেই হয়। সাঁকোটিতে রং-রস-রূপের মাধুর্যে এই শুদ্ধতম কবির শিল্পীসত্তার অহংকার মিশে আছে নিবিড় মমতায়। এ এক অভিনব সখ্য, ওপারে দাঁড়িয়ে আছেন জীবনানন্দ দাশ, এপারে আমরা কুয়াশা ভেঙে ভেঙে গুচ্ছগ্রাম বানাই কিংবা জলজ আঁধারে বৃক্ষের কাছে হাত পাতি শব্দের খোঁজে। এই সাঁকোটি কালের নিরালম্ব স্রোতে এক আশ্চর্য বাতিঘর, সেখানে দাঁড়াতেই হয়, এ এক মহাতীর্থ আমাদের।
কবিতার চঞ্চলা হরিণী ধরা দিয়েছিল তাঁর কাছে কোনো এক পৌষ-সন্ধ্যায়, তিনি বুঝেছিলেন ‘সে যেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা হয়।’ অন্ধকারের যোনির ভেতরে তিনি সৃষ্টির অপার সম্ভাবনাকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। প্রকৃতির নিবিড় অবলোকনের ক্ষমতা তিনি পেয়েছিলেন তার অন্তর্গত বিষাদ থেকে। অনেক ভেতরে খুঁড়ে খুঁড়ে সংগ্রহ করেছিলেন কবিতার আকর,মণি-মুক্তো, কৈবল্যের উড়ন্ত পত্রালি। তাঁর কবিতার অন্তরালে যে গানের দীপাবলি মনকে অন্যভাবে আবিষ্ট করে, সেখানেও আমাদের দাঁড়াতে হয়, ভাবতে হয় এই নির্জনতম কবির প্রজ্বলিত হৃদয়ের অভিজ্ঞান কীভাবে কালিক সত্যকে বহন করে বয়ে যায় কালান্তরে।
এজরা পাউন্ড কবিদের বলেছিলেন ‘জাতির অ্যান্টেনা’। তিনি বিশ শতকের কবিতা-আন্দোলনের প্রধান পুরুষ, যিনি খাঁটি কবিতার পক্ষেই ওকালতি করেছেন সারাটা জীবন। জীবনানন্দ দাশ সেই খাঁটি কবি, যাঁকে আমরা বাংলা আধুনিক কবিতার প্রধান রূপকার বললে তাতে কোনো অত্যুক্তি হবে না। তাঁকে কবিদের কবিও বলা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের পরে তিনিই সবচেয়ে বড় কবি এবং তিরিশের কবিদের মধ্যে তাঁর কবিতাই বহুলপঠিত ও নন্দিত। বর্তমানে যাঁরা বাংলা কবিতার প্রধান কবি হিসেবে পরিচিত, তাঁদের সবাই জীবনানন্দ দ্বারা প্রাথমিকভাবে প্রভাবিত ছিলেন এবং সে-প্রভাব কাটিয়ে উঠতে অনেককেই অনেক পথ হাঁটতে হয়েছে এবং অনেক বড় কবির কবিতায় আজো বয়ে গেছে জীবনানন্দীয় আবহ কোনো-না-কোনোভাবে। শামসুর রাহমান, শঙ্খ ঘোষ এবং উৎপলকুমার বসু থেকে শুরু করে অন্যরা, পঞ্চাশ-ষাটের সব কবিই বলতে গেলে, জীবনানন্দের জগৎ হয়েই নতুন কবিতার পথ নির্মাণ করেছেন, আবার কেউ কেউ সে-চেষ্টায় আজো অবিরাম পথ কেটে চলেছেন নিরলসভাবে এবং এ-কথা সত্য যে, জীবনানন্দ-মুক্তি আজ কবি হয়ে-ওঠার অন্যতম প্রধান শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ তাঁর কবিতাপাঠ আমাদের অস্তিত্বের   অন্তর্তল এমনভাবে স্পর্শ করে যে, তা হয়ে ওঠে অস্তিত্বের অনিবার্য পাঠ। তিরিশের কবিদের মধ্যে তিনিই একমাত্র কবি, যাঁকে প্রথম জীবনে অনেক ধকল সহ্য করতে হয়েছে সম্পূর্ণ নতুন কবিতা লেখার অপরাধে। একমাত্র বুদ্ধদেব বসুই বুঝেছিলেন বাংলা কবিতায় একজন প্রোফেটের আগমন ঘটেছে এবং তিনিই সর্বপ্রথম সবাইকে জানিয়ে দিলেন জীবনানন্দ দাশই ‘খাঁটি আধুনিক’ কবি।
এ-কথা সবারই জানা যে, বুদ্ধদে বসুর আগে তাঁকে নিয়ে বা তাঁর কবিতা নিয়ে কেউ কোনো প্রশংসার বাণী তো দূরের কথা, তাঁর সহকর্মীরা পর্যন্ত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন। এমনকি সুধীন দত্তের মতো কবিও তাঁর পত্রিকায় জীবনানন্দ দাশের কবিতা না ছেপে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এসবের কারণ হলো, তিনি ছিলেন দূরবর্তী সময়ের সচেতন কবিব্যক্তিত্ব। তাঁর সময়ের সেই জনপ্রিয় কবি-পুরোহিতদের কেউ কেউ কবেই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন, বেঁচে আছেন তিনি আজো সাবলীল অহংকারে কবিতার বরপুত্র হিসেবে। তিনি চর্যাপদ থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এবং বাঙালির হাজার বছরেরও বেশি সময়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-ইতিহাসকে আত্মস্থ করেছিলেন নিমগ্ন সাহসে এবং পাশ্চাত্য শিল্প-সাহিত্য-দর্শন-নন্দনতত্ত্বের নানাবিধ অনুষঙ্গের অন্তর্গত নির্যাসও তিনি পান করেছেন সৃজনতেষ্টায় এবং তার সবটুকু জীবনকে তিনি ঢেলে দিয়েছিলেন কবিতার পাত্রে, যা আমরা পান করছি  গন্ডূষে গন্ডূষে এবং অনাগতকালের কবিরাও করবে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ তিনি ‘সময়োত্তর’ কবি; কবিতা ও জীবনকে তিনি একাকার করে ফেলেছিলেন এবং জীবনকে মন্থন করে কবিতা-অমৃত দিয়ে গেছেন আমাদের। তাঁর অস্থিমজ্জার জারকরসে নির্মিত বিশাল সঞ্চয়ই বাংলা কবিতার কালসঞ্চারী আলো, যার মধ্যে দিয়ে আমরা দেখতে পাই আমাদের চিরায়ত বাঙালিসত্তার বিচিত্র বৈভব।
তাঁর অনেক কবিতাই জটিল ও বিস্ময়কর—
‘ফিরে এসো সুরঞ্জনা নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে’
এর অর্থ কী, এ-ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্তে আসা মুশকিল হলেও আমরা এ-পঙ্ক্তি নির্মাণের কারুকার্যে চমৎকৃত হই। কবিতা বা যে-কোনো লেখনশিল্পই যখন টেক্সট, তখন তাঁর ভেতর বিশেষ কোনো অর্থ খোঁজার প্রচেষ্টা আজ বাতুলতা মাত্র। তিনি তাঁর কবিতাকে টেক্সট করে  তুলতে পেরেছিলেন বলেই তাঁর কবিকৃতি তাঁর সময়ের অন্য কবিদের মতো ম্রিয়মাণ হয়ে যায়নি, বরং তাঁর কবিতার দ্বন্দ্ব-সংঘাত-বৈপরীত্য-জটিলতা পাঠককে আরো উৎসুক করে তুলছে ক্রমাগত।
জীবনানন্দের কবিতা ‘পড়সসঁহরপধঃব’ করে নবভড়ৎব রঃ রং ঁহফবৎংঃড়ড়ফ, তাঁর অনেক কবিতারই কাব্যরস আস্বাদনের পরও তা আমাদের কাছে দুর্বোধ্য, রহস্যাবৃত থেকে যায়। ‘অ ঢ়ড়বস ংযড়ঁষফ হড়ঃ সবধহ নঁঃ নব’,  যা জীবনানন্দের কবিতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সত্য হয়ে দাঁড়ায়। কবিতা যে ‘ংবঢ়ধৎধঃব ষধহমঁধমব’ এবং ‘ফরভভবৎবহঃ ংঁনলবপঃং’ সে-কথা বিবেচনায় রেখে নির্বিঘ্নে বলা যায়, তিনি একজন বড়মাপের কবি, আর সেসব গুণের অভাবেই ‘সকলেই কবি নয়; কেউ কেউ কবি’।
জীবনানন্দ দাশ একটি কবিতার গঠনে যে শ্রম ও সময় দিয়েছেন, তা শঙ্খ ঘোষের কথায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে—
‘যদি তাঁর রচনাবলির ভেরিওরাম সংস্করণ ছাপা হয় কখনো, দেখতে পাব যে কোন-কবিতায় কত অসংখ্য তাঁর পাঠান্তরের প্রক্রিয়া। আর তাঁর আপাত-বিহবল ‘কবিতার কথা’র প্রবন্ধগুলি বিশ্লেষণ করলে ধরা পড়বে, কবিতার শরীর নিয়ে, তাঁর ছন্দ নিয়ে কত সতর্কভাবেই ভাবতে চেয়েছিলেন তিনি দিনের পর দিন।’ (‘ছন্দের বারান্দা’)
শঙ্খ ঘোষ থেকে আমরা আরো জানতে পারি যে, ‘সহজ শব্দে শাদা ভাষায় লিখেছি বটে, কিন্তু তবু কবিতাটি হয়ত অনেকে বুঝবে না; খাতায় এরকম মন্তব্য লিখে রেখেছিলেন জীবনানন্দ, তাঁর ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটির বিষয়ে’ (ওই) যা তাঁর অনেক কবিতার ক্ষেত্রেই সত্য; পরিচিত শব্দ আর পরিচিত ভূগোলের মধ্যেই এক দুর্বোধ্য লুকোচুরি খেলা।
এটা ঠিক যে, তাঁর কবিতা তাঁর উন্মেষকালে বাঙালি পাঠকের কাছে খুবই নতুন ও অপরিচিত ছিল। আজ তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তার কালেও তাঁর কিছু  কবিতার অস্থিমজ্জায় এমন অতিবর্তী কল্পনা ও চিন্তার প্রলেপ লেগে আছে, যা আমাদের বিভ্রান্ত করে।
‘কেউ যাহা জানে নাই কোন এক বাণী’ – তিনি  তা-ই বয়ে এনেছেন এবং সে-হিসেবে তিনি কবিতার প্রোফেট (নতুন বার্তাবাহক)। তিনি বলেছেন : ‘মহাবিশ্বলোকের ইশারা থেকে উৎসারিত সময়চেতনা আমার কাব্যে একটি সঙ্গতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতো;     কবিতা লিখবার পথে কিছুদূর অগ্রসর হয়েই এ আমি বুঝেছি, গ্রহণ করেছি। এর থেকে বিচ্যুতির কোন মানেই নেই আমার কাছে। তবে সময়চেতনার নতুন মূল্য আবিষ্কৃত হতে পারে।’
এই সময়চেতনার অপরিহার্য বোধই কোনো কবিকে কালোত্তীর্ণ করে তোলে। তিনি যে সবার থেকে আলাদা, সে-ব্যাপারে তিনি নিজেই বলেছেন :
‘সকল বোধের মাঝে বসে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা।’
পৃথিবীর অনেক প্রতিভাবান শিল্পীই এভাবে নিজের আলাদা সত্তার ঘোষণা নিজেই দিয়েছেন যখন অন্যেরা সেই আলাদা সত্তার খোঁজ পেতে ব্যর্থ হয়েছে। টি এস এলিয়েটের একটি কথা স্মর্তব্য, প্রত্যেক প্রধান কবিই তাঁর সৃষ্টিকর্মে এমনকিছু রেখে যান যা থেকে ভবিষ্যৎ কবিতার গোড়াপত্তন হতে পারে; – জীবনানন্দ দাশ সে-মাপেরই বড় কবি এবং আজ আধুনিক-উত্তর কবিতার যে-কথাবার্তা চলছে সেই আধুনিক-উত্তর অথবা, উত্তরাধুনিক বা অধুনান্তিক যাই-ই বলি না কেন, সময়েরই আবদার কোনো নতুন কবিতার এবং সেই নতুন কবিতার বীজ রয়েছে জীবনানন্দে। সুতরাং আজকের কবিদের জন্য আধুনিক-উত্তর কবিতার গোড়াপত্তনে জীবনানন্দ পাঠ যেমন অপরিহার্য, তেমনি জীবনানন্দ-মুক্তিও আবশ্যক। কারণ, কবি হিসেবে স্বকীয়তা অর্জনের ক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশ একটি বড় রকমের বাধা – এই প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করেই পৌঁছতে হবে নতুন কবিতার জগতে।
তাই অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত যখন বলেন, ‘জীবনানন্দ এখনো বাংলা ভাষার পদকর্তাদের স্বকীয়তার পক্ষে সম্ভবত সবচেয়ে প্রতিকূল শক্তি’, তখন আর বলার কিছুই থাকে না। তিনি বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের পরেই প্রধান ও প্রতিনিধিত্বশীল কবি। তিনি যে বড় কবি সে-ব্যাপারে কোনো সন্দেহই থাকে না যখন বুদ্ধদেব বসু বলেন—
‘এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে চলতিকালের কাব্যরচনার ধারাকে তিনি গভীরভাবে স্পর্শ করেছেন, সমকালীন ও পরবর্তী কবিদের উপর তার প্রভাব কোথাও-কোথাও এমন সূক্ষ্মভাবে সফল হয়ে উঠেছে যে বাইরে থেকে হঠাৎ দেখে চেনা যায় না।’(‘কালের পুতুল’)
তাঁর সময়ের কবিদের মধ্যে তিনিই একমাত্র কবি, যিনি রবীন্দ্রনাথের ভাব ও ভাষা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক একটি পথ তৈরি করে নিয়েছিলেন – বাংলা কবিতায় একটি আলাদা সুর ও স্বরের সৃষ্টি করেছিলেন। শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন—
‘রবীন্দ্রনাথের কবিতায় নয়, আধুনিক পাঠক তার জীবন খুঁজে পান জীবনানন্দেরই রচনায় – ‘কবিতা’ পত্রিকার শেষ পর্যায়ে প্রত্যক্ষ-তুলনা দিয়ে একথা বলতে শুরু করলেন নিরূপম চট্টোপাধ্যায় বা জ্যোতির্ময় দত্তের মতো সেদিনকার তরুণেরা’
এই বোধ পরবর্তীকালের অনেক আধুনিক কবির মধ্যেই আমরা লক্ষ করেছি। কারণ, সময় বদলায় এবং বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় জীবন, জীবনবোধ এবং জীবনের চাহিদা। আমরা ইতোমধ্যে বলেছি, পরবর্তীকালের কবিদের ওপর তাঁর সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথা। তিনি এক অফুরন্ত সময়কে কাব্যবৈচিত্র্যের বিধুরভুবনে অন্বিত করেছেন, যেখানে বাঙালির জীবনসত্যের আকাশখানি ঝলসে ওঠে রক্তিম আলোকে। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে ‘বাংলা কাব্যের ঐতিহ্য স্রোতের মধ্যে একটি মায়াবী দ্বীপের মতো’ মনে করেছেন, যা ‘বিচ্ছিন্ন ও উজ্জ্বল’, সেই মায়াবী দ্বীপ আজ ফলে-ফুলে, গন্ধরস ছড়িয়ে আমাদের কাব্যপ্রেরণাকে যেমন উসকে দেয়, তেমনি আক্রান্তও করে। তাঁর কবিতার রহস্যদ্যুতিতে আমরা চমকিত হই, ভেবে ভেবে অস্থির হই সে-রহস্য উদ্ঘাটনে।
তাঁর অনেক কবিতাই আমাদের কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়। এর কারণ, মহৎ কবিরা আমাদের মতো সাধারণ পাঠকদের থেকে যুগ যুগ সামনে এগিয়ে থাকেন। কবিতার ড়নংপঁৎরঃু তাই              চিন্তা-চেতনারই একটি ব্যবধান মাত্র। সেই ব্যবধান কমে এলে বা ঘুচে গেলে কবিতাও সহজ হয়ে আসে। তাঁর কবিতার ভিন্ন ভিন্ন পাঠ ও আবিষ্কার আমাদের কাব্যপিপাসু মনকে নানাভাবেই তৃপ্ত করে – আর এ-কারণেই আজকের আধুনিক-উত্তর সময়ের যে-চাহিদা শিল্পের কাছে, কবিতার কাছে, তা জীবনানন্দে খুঁজে পাওয়া যায়। মায়াকোভস্কি বলেছিলেন, ‘কবিতা লেখার জন্য নতুন কাব্যভাষা সৃষ্টি বাধ্যতামূলক।’ রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা কবিতায় আর কোনো নতুন কথা, নতুন ভাষায় ভাব প্রকাশ সম্ভব কিনা এ নিয়ে যখন অনেকেই ভাবিত, ঠিক সে-সময়েই জীবনানন্দের আবির্ভাব।
এ-কথা মানতেই হবে যে, তাঁর কবিতায় রয়েছে দূরসময়ের ইঙ্গিত। তিনি কবিতাকে গ্রহণ করেছিলেন একই সঙ্গে হৃদয়ে ও আবহমান ইতিহাসের চৌকাঠে এবং রক্তাক্ত, শহিদ হয়েছেন কবিতার বেদিতে। তাঁর সঞ্চয় এত বিপুল ও সম্ভাবনাময় যে, কোনো বিশেষ কালের নিরিখে তা বিচার্য নয়, আরো অনেককাল পরে তাঁর কাব্যচেতনার পরিধি ও ভাবলোকের বৈচিত্রকে আরো স্বচ্ছভাবে হয়তো নির্ণীত করা সম্ভব হবে। তিনি আর কারো মতো নন, দুর্বিনীত-বিশৃঙ্খল অনৈতিক সময়ের উঠোনেও তাঁর নক্ষত্র-আলো ঠিকরে পড়বে –  সেই ভরসা তাঁর কাব্যপ্রত্যয়ের দূরগামী চিহ্নগুলোয় ভেসে ওঠে। ফলে আর সন্দেহ থাকে না যে, তিনি ‘সময়োত্তর’ কবি। সে-হিসেবেই বলতে হয় যে, ‘জীবনানন্দ-মুক্তি’ মানে এই নয় যে, জীবনানন্দকে একালের কাব্যভাবনা থেকে একেবারে ছুড়ে দেওয়া – এটা সম্ভবও নয়। এ-কালের কবিদের জন্যে জীবনানন্দ-মুক্তি মানে জীবনানন্দীয় আবেশ থেকে বেরিয়ে আসা এবং একই সঙ্গে তাঁকে ঐতিহ্য হিসেবে গ্রহণ করে (যা কেবল তাঁর ব্যাপক পাঠের মাধ্যমেই সম্ভব) তাঁরই পথের শেষে নতুন পথের সন্ধান করা এবং সেই পথকে বিস্তৃত করা নতুন আঙ্গিকে, সময়ের রংরক্তকে অধিকারের মধ্য দিয়ে।
বাংলা কবিতার বিবর্তনের পরবর্তী ধাপের যে-ইঙ্গিতের কথা বলেছেন বুদ্ধদেব বসু, সেই বিবর্তনের পরবর্তী ধাপের কবিই জীবনানন্দ দাশ। রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা কবিতার প্রধান কবিপুরুষ যে জীবনানন্দ দাশ, এ-ব্যাপারে আজ আমরা নিঃসন্দেহ। তাই বুদ্ধদেব বসুর সুরে সুর মিলিয়ে বলতেই হয় যে, বাংলা কবিতার বিবর্তনের পরবর্তী ধাপের ইঙ্গিত রয়েছে জীবনানন্দের কবিতায়।সেই ইঙ্গিতকে অনুধাবন ছাড়া তাঁর মতো বড়মাপের কবি হওয়া সম্ভব নয়, যার কবিতা বহন করবে পরবর্তী কালের কবিতার বীজ। ‘কবিতার কথা’ গ্রন্থে জীবনানন্দ দাশ তাঁর এক লেখায় বলেছেন :
‘আধুনিকদের অনুভূতি ও বোধ রবীন্দ্রনাথের স্তরে নেই, সরে গেছে, বিশেষ হয়েছে। আধুনিকদের কাল কেটে গেলে আরেক রকম স্বতন্ত্রতায় দাঁড়াবে কবিতা …।’ সে কবিতাকে গ্রহণ করবার জন্যে অনুভূতি ও আলোচনা ঠিক আজকের ভাবনা বিচারের কোণ থেকে কাজ করতে পারবে না।
কবিতা আলোচনার সেই নতুন অনুভূতির অভাব সর্বত্রই পরিলক্ষিত আজ। ফলে সাম্প্রতিক সময়ের কবিতাচর্চা নিয়ে এক নৈরাজ্যিক অবস্থার সূচনা হয়েছে সংগত কারণেই। ইতোমধ্যে জীবনানন্দ-উত্তর বাংলা কবিতায় অনেক বড়মাপের কবির জন্ম হয়েছে এবং তাঁরা বাংলা কবিতাকে আরো বিস্তৃত ও বিকশিতও করেছেন, অনেকেই জীবনানন্দের ভাষা ও আঙ্গিক থেকে পৃথক কাব্যভাষায় কবিতা লিখেছেন ও লিখছেন, কিন্তু এ-কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, তাঁর মতো দূরসময়ের কবি, প্রধানতম কবি যিনি সবকিছুকে পেছনে ফেলে সবকিছু আলোকিত করে জ্বলে উঠবেন মাথার উপরে – এরকম কালোত্তীর্ণ মহত্তম কবি এখনো আমরা পাইনি। অজস্র পদ্যলেখক ও ভাঁড়ের ভিড়ে যখন প্রকৃত কবি ও কবিতা দূরে সরে যাচ্ছে, তখন আরেকটি নক্ষত্রের আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার অবাধ বাসনা আমাদের অধীর করে তোলে। আমরা অপেক্ষায় আছি, একদিন তিনি আসবেন – নতুন কবিতার গন্ধ চোখে মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করবেন—
‘আমার পায়ের শব্দ শোন,নতুন এ-
আর সব হারানো পুরোনো’
অথবা অন্য কোনো ঐন্দ্রজালিক স্বরক্ষেপণে তিনি পৌঁছে যাবেন অলক্ষেই আমাদের মাঝে।
জীবনানন্দ দাশের ‘হায় চিল’ এবং ইয়েটসের ‘ঐব জবঢ়ৎড়াবং ঞযব ঈঁৎষব’ি-এর তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে জীবনানন্দ গ্রন্থে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বলছেন—
‘আসল কথা, কোনো কবিই উত্তরাধিকারের দায় থেকে মুক্ত নন। তিনি কীভাবে ওই দায়ভাগ থেকে নতুন দায়িত্ববোধ তৈরি করে নেবেন, সেটাই  হলো বিবেচ্য। এদিক থেকেই আমাদের আলোচনার পরবর্তী অংশটি সূচিত হতে পারে। আমাদের প্রভাবসন্ধানী মনের সহজাত প্রলোভন নিশ্চয়ই পূর্বগামীর কোনো পদ উত্তরসাধকের কোনো পদ্যে কীভাবে অনুসৃত হলো, সেদিকেই নিবদ্ধ। কিন্তু তুলনামূলক সাহিত্যের কোনো অপ্রতিভ শিক্ষার্থীও আজ এভাবে কোনো উত্তীর্ণ কবিতার উৎকর্ষ-অপকর্ষ বিচার করতে যাবেন না। তিনি দেখতে চাইবেন, মোটিভসংক্রান্ত প্রভাবসত্ত্বেও পরবর্তী কবি কোন শিল্পভাবনার টানে মৌল অনুষঙ্গকে দুমড়ে-মুচড়ে ব্যবহার করেছেন।’
এই বোধ থেকে ভাবতে পারলে প্রভাবসংক্রান্ত সংস্কারের বেড়াজাল ডিঙিয়ে আলোকিত ময়দানে এসে দাঁড়ানো সম্ভব এবং কবি ও কবিতার আলোচনা-সমালোচনার পথও অনেকখানি প্রশস্ত হয়ে ওঠে। জীবনানন্দ দাশের প্রভাব কাঁধে নিয়েও নতুন কবিতা লেখা সম্ভব, কারণ মৌলিক প্রতিভার কাছে প্রভাব মূলত শিল্প-আকর ছাড়া আর কিছু নয়।
জগতের অন্যসব আলোড়ন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জীবনানন্দ দাশ শুধু কবিতাকেই জীবনের কাছে টেনে নিয়েছিলেন। বুদ্ধদেব বসুর কথায় বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে—
‘এই রকম আক্রমণের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যে ছিলেন জীবনানন্দ, তাতে আমার যেমন উত্তেজনা হতো নিজের বিষয়ে মন্তব্য পড়েও তেমন হতো না; যেহেতু তার কবিতা আমি অত্যন্ত ভালোবেসে ছিলুম, আর যেহেতু তিনি নিজে ছিলেন সব অর্থে সুদূর, কবিতা ছাড়া সব ক্ষেত্রে নিঃশব্দ, তাই আমার মনে হতো তার বিষয়ে বিরুদ্ধতার প্রতিরোধ করা বিশেষভাবে আমার কর্তব্য।’(‘জীবনানন্দ দাশ’, কবিতা, পৌষ ১৩৬১)
কেবলই কবি হতে চাওয়া এক নির্মম প্রার্থনা; এই প্রার্থনার কোনো ভূগোল নেই, মানচিত্র নেই, নেই কোনো সবুজ বনভূমি – এ এক নিঃসঙ্গ যাত্রা সম্ভাবনার সাত সমুদ্রপাড়ে। আর মৌলিক কবি হতে হলে এই সিঃসঙ্গ যাত্রার যাত্রী হওয়ার আর কোনো বিকল্প নেই।
ওই সাঁকোটি এখন এক ঐন্দ্রজালিক আলোর ভেতরে দোল খায়। ওই সাঁকোটি এখন মহাকালের শিল্প-মৌতাত, আমাদের আনন্দ-বেদনা-বিম্বিত আরশি, ওখানের গভীর আঁধারে আমাদের মন খুঁজে পায় দুদন্ড আশ্রয়। তার পাশে আরো অনেক অনেক নতুন সাঁকোর গোড়াপত্তন হলেও নতুন নতুন কবিতা-অভিযাত্রিকের আগমন-প্রস্থানে আমরা আলোড়িত হলেও কেন যেন সেখানে ফিরে ফিরে যাওয়া, সেই ঐন্দ্রজালিক আলোর ভেতরে। জীবনানন্দ দাশ সত্যিই এক নক্ষত্রবিম্বিত জলাশয়, নিবিড় শিল্প-প্রত্যয়ে তাকে না দেখলে তাঁর কবিতার গহিনের রূপ-সৌন্দর্য উপভোগ করা সম্ভব নয়, তার অনুভবের বিচিত্র জগৎ অধরাই থেকে যাবে পাঠকের কাছে।
নির্জনতার মধ্যে অবগাহন করে তিনি খুঁজতেন কবিতার নিবিড় নীরব পথ। জীবনের অপরাপর বিষয়-আশয় তার কাছে তুচ্ছ বলে মনে হতো। কবিতা ছাড়া সবকিছু থেকে একটু দূরে থাকতেই ভালোবাসতেন তিনি। মানুষের অগাধ সান্নিধ্যেও তিনি নিঃসঙ্গ ছিলেন আর সে কেবল ওই কবিতার কারণেই। আবার এ-কথাও সত্য যে, ‘যেখানে সভ্যতা বা সংস্কৃতি নেই, সেখানে শুধু প্রকৃতি বা নির্জনতা নিয়ে তিনি থাকতে পারেন নি।’
প্রকৃতির আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে তিনি কবি, তাঁর বিচিত্রমুখী কাব্যপ্রত্যয় প্রকৃতির আশ্রয়েই লালিত-পালিত, বিকশিত। একটি বিশেষ সময়ে তিনি প্রকৃতি ছেড়ে সমাজচেতনা তথা গণচেতনার দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন, যা ছিল তাঁর কবিস্বভাবের বিরুদ্ধযাত্রা। তবু তিনি সেই যাত্রা করেছিলেন, তিনি হয়তোবা প্রলুব্ধ হয়েছিলেন – সময়টা ছিল সে-ধরনেরই – গণগন্ধময়। মূলত বাংলাদেশেরই প্রকৃতিচিত্র জীবনানন্দে দেখা যায়। যদিও দীর্ঘ সময়ই তিনি কলকাতায় কাটিয়েছেন নগরজীবনের জনকোলাহলে, তাঁর কবিতায় সেসব বিষয়-আশয় মাড়িয়ে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত জন্মভূমি বরিশাল তথা বাংলাদেশের জল-নদী-মাঠ-পাখি-পথ-ঘাট-নিসর্গ-প্রকৃতি বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। ‘বাংলার মুখ’ তিনি দেখেছেন, তাই তিনি পৃথিবীর রূপ আর খুঁজতে যান না। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে ‘নির্জনতম কবি’ বলেছিলেন, তাঁর এই নির্জন জীবনবিন্যাস গাড়ীকৃত হয়েছে প্রকৃতির সান্নিধ্যেই। প্রকৃতি, এটা ঠিক যে ‘চিত্ররূপময়’, কিন্তু তারও অধিক কথা তাঁর প্রকৃতিবিষয়ক কবিতার ভেতরে থেকে যায়, যা নানাভাবেই বিশ্লেষণের যোগ্য। সাদামাটা কথায় নিছক যদি প্রকৃতি বর্ণনার কথা বলা হয়, তাহলে তা আমাদের এই চারপাশের পরিচিত জনপ্রান্তর হিজল-তমাল-শালিখ-নদী-খাল-বিল-কাক ও  কোকিল এবং এর মধ্যেই নিহিত তাঁর বাংলাদেশ প্রীতির পরিচয়।
‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে
অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে’
(‘অবসরের গান’)
‘পাখির ডিমের খোলা, ঠান্ডা-কড় কড়!
শসাফুল – দু-একটা নষ্ট শাদা শসা
 মাকড়ের ছেঁড়া জাল, শুকনো মাকড়সা
ইঁদুর পেঁচারা ঘুরে যায় মাঠে মাঠে,… ’
(‘পঁচিশ বছর পরে’)
এসব দৃশ্য আমাদের অত্যন্ত চেনা ও জানা এবং একেবারেই দেশজ। মাটি অন্বিষ্টতা কতখানি প্রগাঢ় হলে এসব ছবি আঁকা যায় তা অনুমেয়। উত্তরাধুনিকরা বলছেন – মানুষ ছাড়া তারা এখন কবিতায় দেখতে চাচ্ছে কীটপতঙ্গ ও অন্যসব মাইনর জিনিস। সেক্ষেত্রে এখানে জীবনানন্দকে আদর্শ উত্তরাধুনিক কবিই বলতে হবে বইকি! এ ছাড়া পাখি, শকুন, বিড়াল ইত্যাদি নামে তাঁর যেমন কবিতা রয়েছে, তেমনি তাঁর অনেক কবিতায়ই পশুপাখির নানাবিধ উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
‘অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে
চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে বসে আছে
ভোরের দোয়েলপাখি’
(বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি)
এসব চিত্রকল্পে বাংলার চিরন্তন প্রকৃতি-দৃশ্যই ভেসে ওঠে স্বাভাবিক প্রত্যয়ে এবং
‘কৃষ্ণ দ্বাদশীর জ্যোৎস্না এখন মরিয়া গিয়াছে নদীর চড়ায়’
প্রকৃতির এই কাব্যায়ন আমাদের নিয়ে যায় জীবনের অন্য কোনো মোড়ে – এই বিমুগ্ধ বৃত্তায়নই জীবনানন্দের কাব্যশক্তির ভিন্নতর দিক। গ্রামবাংলার যেসব দৃশ্য প্রতিদিনই আমাদের চোখে ভাসে – সেই চিরচেনা দৃশ্য – সেই অন্তর্ভেদী জীবনঘনিষ্ঠ পথঘাট, বিজন প্রান্তর এবং শাশ্বত গ্রামীণ নিসর্গের বিস্তার দেখা যায় তাঁর ‘আকাশে সাতটি তারা’ কবিতায়। আকাশে সাতটি তারা জ্বলে উঠলে তিনি দেখতে পান
‘বাংলার নীল সন্ধ্যা কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে’
এছাড়া …
‘নরম ধানের গন্ধ-কলমির ঘ্রাণ,
হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল,
চাঁদা সরপুঁটিদের মৃদু ঘ্রাণ,
কিশোরীর চাল-ধোয়া ভিজে হাত – শীত হাতখান
লাল লাল বটের ফলের
ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতা
এরি মাঝে বাংলার প্রাণ :’
বাংলার শ্যামল নিসর্গ এবং এসব চিত্র ও চিত্রকল্পে লেপ্টে আছে কবির মমতাময়ী দেশচেতনার নিগূঢ়তা। যে-কবি ‘চাঁদা সরপুঁটিদের মৃদু ঘ্রাণ’ পান আর ‘লাল লাল বটের ফলের ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতা’ অবলোকন করেন, সে-কবিকে বাংলাদেশের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছাড়া আর কী ভাবা যেতে পারে! তাঁর কবিতায় ইন্দ্রিয়পরায়ণতার (ংবহংঁড়ঁংহবংং) ব্যাপ্তি যে কীটসকেও ছাড়িয়ে যায় কখনো কখনো, সে-কথা বলাই বাহুল্য। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে ‘আপাদমস্তক রোমান্টিক’ বলেছিলেন। তাঁর রোমান্টিক-ইম্প্রেশনিস্টিক ভাববলয়ের বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকৃতির বহুমাত্রিক উপাত্তসমূহে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপতিত, যা কালিক প্রেক্ষাপটে এক চিরন্তন বৈচিত্র্যে সংস্থিতি পেয়েছে। যে-কারণে তাঁর প্রকৃতির  কবিতা আমাদের অভিনব জাগতির আস্বাদ দেয় প্রতিটি পাঠে।
এইখানে আম লিচু কাঁঠালের বন,
ধনপতি, শ্রীমন্তের, বেহুলা, লহনার ছুঁয়েছে চরণ;
মেঠোপথে মিশে আছে কাক ও কোকিলের শরীরের ধূল,’
(এখানে আকাশ নীল)
তাঁর কবিতায় যেমন বাংলার অতিপরিচিত ফলের বাগান মূর্ত হয়ে ওঠে, তেমনি লোককথার, উপকথার বেহুলা, লহনারও উল্লেখ পাওয়া যায় – এবং ফিরে ফিরে আসে কাক, কোকিল ও বাংলার অন্যান্য চিরচেনা পাখির কথা। মৃত্যুর পরে তিনি বাংলার বুকে শুয়ে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
‘একদিন মৃত্যু এসে যদি দূর নক্ষত্রের তলে
অচেনা ঘাসের বুকে আমারে ঘুমায়ে যেতে বলে,
তবুও সেই ঘাস এই বাংলার অবিরল ঘাসের মতন
মউরীর মৃদু গন্ধে ভরে রবে,’
(‘দূর পৃথিবীর গন্ধে’)
বাংলার কোনপথে তিনি হাঁটেননি, সব পথ সব নদী সব প্রান্তরেরই তিনি প্রাজ্ঞ পথিক।
‘গোরুর গাড়িটি যায় মেঠোপথ বেয়ে ধীরে ধীরে;
আঙিনা ভরিয়া আছে সোনালি খড়ের ঘন স্তূপে;
(সন্ধ্যা হয় – চারিদিকে শান্ত নীরবতা)
‘পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;’
এখানে  আপাত রোমান্টিকতার আড়ালে তিনি তাঁর প্রকৃতিপ্রেমকে ব্যাপকতা দিয়ে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত খাড়া করেছেন। এমনকি তাঁর ‘অন্ধকার’ কবিতায় যেখানে মৃত্যুচেতনা প্রগাঢ় রূপ পেয়েছে, সেখানেও ‘ধানসিঁড়ি নদীর কিনারে’ শুয়ে থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন।
‘আকাশের রঙ ঘাস ফড়িং-এর দেহের রঙের মতো কোমল নীল’ ‘চারিদিকের পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ’ (শিকার) খুব সরল ও সোজা কথায় হলেও এরকম উপমা বাংলা কবিতায় আমরা তার আগে দেখিনি কিংবা ‘মোরগ ফুলের মতো লাল আগুন’ উটের গ্রীবার মতো কোনো নিস্তব্ধতা এসে’, ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ’ – এসব উপমা চিত্রকল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় তাঁরই কথা যে, ‘উপমাই কবিতা নয়, উপমাতেই কবিত্ব’। তার এসব উপমা এবং আরো অনেক অনেক ডিকশন এতটাই নতুন ও অপূর্ব যে, কয়েক দশকেও তার আবেদন শেষ হয়নি এবং বলতে গেলে সাম্প্রতিক সময়েও তিনি আমাদের প্রধান প্রতিবন্ধক নতুন করে কোনো কিছু বলার, আর  সে-ক্ষেত্রেই তাঁর মৌলিক কবিপ্রতিভার পরিচয় ফুটে ওঠে।
পুনরুজ্জীবনবাদী চেতনা ভারতীয় হিন্দু ধর্মমিথের একটি অংশ। মৃত্যুর পর মানুষের পুনরাগমন – যে-কোনো পশুপাখির বেশে এবং ভাবা হয় পার্থিব জীবনের পাপ-পুণ্যের ওপর এই পশুপাখির ধরনটা নির্ভর করে। জীবনানন্দ দাশ সর্বান্তঃকরণে পুনরুজ্জীবনবাদী চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন – বাংলার  মাটি-জল, নিসর্গের অনুপম সৌন্দর্য, স্নিগ্ধ কাশবন হিজলের ছায়া এবং কাক কোকিলসহ বাংলার সবকিছুর মায়ায় তিনি এতটাই আপ্লুত ছিলেন যে, তিনি তাঁর অনেক কবিতায়ই মৃত্যুর পরে ফিরে আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে – এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় – হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে,
হয়তো বা হাঁস হবো – কিশোরীর – ঘুঙুর রহিবে লাল পায়
সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে
আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে।’
প্রকৃতির সাম্রাজ্য হয়ে প্রেম ও জীবনের বোঝাবোঝি শেষে তিনি ইতিহাস-চেতনায় অন্বিষ্ট হয়েছেন; অতীত ইতিহাসের দরজায় বারবার টোকা দিয়েছেন বোধের সংকীর্ণ চৌহদ্দি থেকে  বিস্তৃত পরিসরে – যে-কারণে আমরা তাঁর কবিতায় দেখি গ্রিস-মিশর, বিম্বিসার-অশোকের কিংবা কনফুসিয়াস বা বুদ্ধের কথা। ইতিহাসচেতনা বা কালচেতনা তাঁর কবিতার ঐশ্বর্যে একটি বিশেষ সংযোজন। তাঁর শেষের দিকের কবিতাগুলোয় যন্ত্রসভ্যতার নানাবিধ অনুষঙ্গের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। কিমাকার ডাইনামো, হাইড্র্যান্ট, ট্রামের লাইন, মাইক্রোফোনসহ আধুনিক সভ্যতার অনেক প্রপঞ্চের সার্থক প্রয়োগ তাঁর কবিতায় রয়েছে।
তাঁর শেষের দিকের কবিতায় সমাজমনস্কতা কাজ করেছিল এবং আমরা জানি, সে-ব্যাপারে বুদ্ধদেব বসুর বেশ আপত্তিও ছিল। যাহোক, জীবনানন্দ যে কেবল প্রকৃতির কবি কিংবা নির্জনতার কবি, এ-অপবাদ তিনি ঘুচিয়েছিলেন।
‘যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;/ যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।’ আজকের এই পৃথিবীতে যে-অনাচার এবং যারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে পরিচালনার মাধ্যমে গণমানুষের ভাগ্যোন্নয়নের মালিক হয়ে উঠেছে, তাদের হৃদয়হীন কর্মকান্ড এবং আগ্রাসনবাদী মানসিকতা আমাদের সে-কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। পাশাপাশি ‘যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি/ শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।’ এভাবে তাঁর কবিতা লেখার একটি বিশেষ সময়ে তিনি সমাজচেতনার বিষয়-আশয় কবিতায় আনলেন। তিনি নিজে বলেছেন, ‘হতে পারে কবিতা জীবনের নানা রকম সমস্যার উদ্ঘাটন, উদ্ঘাটন দার্শনিকের মতো নয়; যা উদ্ঘাটিত হলো তা যে-কোনো জঠরের থেকে হোক আসবে সৌন্দর্যের রূপে, আমার কল্পনাকে তৃপ্তি দেবে; যদি তা না দেয় তাহলে উদ্ঘাটিত সিদ্ধান্ত হয়তো পুরনো চিন্তার নতুন আবৃত্তি … কিন্তু তবু তা কবিতা হল না, হলো কেবলমাত্র মনোবীজরাশি। কিন্তু সেই উদ্ঘাটন – পুরনোর ভিতরে সেই নতুন কিংবা সেই সজীব নতুন যদি আমার কল্পনাকে তৃপ্ত করতে পারে, আমার সৌন্দর্যবোধকে আনন্দ দিতে পারে, তাহলে তার কবিতাগত মূল্য পাওয়া গেল।’ (কবিতার কথা)।

সার-সংক্ষেপ :
কবি জীবনানন্দ দাশ কবিতা নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন – সবক্ষেত্রেই যে সফল হয়েছেন এ-কথা বলা যাবে না। তাঁর সমাজভাবনা বিষয়ক কবিতায় কোথাও কোথাও তিনি দার্শনিকতাও করেছেন এবং তাঁর স্বভাববিরোধী কাব্য রচনায়ও ব্রতী হয়েছেন, এটিও ছিল তাঁর একধরনের এক্সপেরিমেন্টই।
বাংলা কবিতার তিরিশের দশকে এ-ধরনের কবিতা লিখিত হয়েছে অনেক কবির দ্বারাই এবং সে-সময়টায় কবিরা এতটাই সক্রিয় ছিলেন যে, সে-ধরনটাই শেষমেশ বাংলা  কবিতার জন্য সত্য হয়ে দাঁড়ায়নি। তবে এ-কথা স্বীকার করতেই হয় যে, জীবনানন্দ দাশ যে-কারণেই হোক সমাজ বা জাতি বা মানুষের সমস্যাখচিত বিষয়কে কেন্দ্র করে কবিতা রচনায় হাত দিয়েছিলেন এবং সেক্ষেত্রে তিনি সফলতা এবং অসফলতার মাঝখানে ‘মহাপৃথিবীর’ তিক্ত-রিক্ত-রক্তাক্ত বিকার ও নগর সভ্যতার কেদ-গ্লানির মুখোমুখি হয়েছেন। এ-সময়ে বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত যেমন, তেমনি জীবনানন্দও পথ বদল করেছিলেন। সময়টা ছিল সাম্যচেতনা এবং নগরচেতনার এবং এই সময়ের কবিতায় তাঁর নগরচেতনার সারাৎসারে নির্বাসিত হয়েছে আগেকার সমস্ত নিসর্গসম্ভার, চিত্ররূপময়তার, সমস্ত পত্রালি-শাখা-প্রশাখা-পত্র-পল্লব। সময়ের পাপে ও চাপেই বলতে গেলে তিনি সরে এসেছিলেন সৃজনশীলতার মৌলিক অভিগমন থেকে এবং ঘোর কেটে গেলে আবার ফিরে গেছেন কেন্দ্রে।
চরম বিষাদ ও হতাশার মধ্যেও একধরনের আশাবাদ ও স্বপ্নের আলো তিনি রেখে যান সমাজ ও সভ্যতার পক্ষে – সুভত্বের পক্ষে ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও থেকে যায় মানব’। বুদ্ধদেব যেমন তার এ-সময়ের কবিতার প্রতি অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন, তেমনি আবার সঞ্জয় ভট্টাচার্য তার শেষের দিকের কবিতায় দেখেছেন ‘জীবনের প্রবীণতা’। তাঁর এ-সময়ের কবিতা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেকেই মতামত রেখেছেন। সেই চল্লিশের দশক থেকে জীবনানন্দ-সমালোচকরা বারবার বাঁক বদলে – বারবার ভুল স্বীকার করে জীবনানন্দকে বিকশিত করেছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় কিংবা অন্যদের আমরা বলতে শুনেছি – আমার সে-সময়ের মতামতের জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব থেকে বোঝা যায় তিনি শুধু বিচিত্র চেতনারই কবি নন, বাংলা কবিতার এমন একটি জায়গায় তার অবস্থান, যেখানে আলো ফেলে নতুন নতুন জগৎ আবিষ্কারের সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
সহায়ক গ্রন্থ :
১। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান— সম্পাদনা: সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত এবং অঞ্জলি বসু, ১ম খণ্ড, সংশোধিত পঞ্চম সংস্করণ, সাহিত্য সংসদ, ২০১০, কলকাতা
২। আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থের পরিশিষ্ট অংশের জীবনপঞ্জি ।
৩। প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্র (জীবনানন্দ দাশ), পরিশেষ ১, ৩: সংসারজীবন, সম্পাদনা: আবদুল মান্নান সৈয়দ, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা।
৪। ক্লিনটন বি সিলি লিখিত আ পোয়েট আপার্ট
৫। হুমাযুন আজাদ সম্পাদিত আধুনিক বাঙলা কবিতা ।
৬। জীবনানন্দের মৃত্যু-ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, ২০০৮।
৭। জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা, জীবনানন্দ দাশ, ভারতি, কলকাতা, ১৯৮৪।
৮। জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা, সম্পাদক আবদুল মান্নান সৈয়দ ও আবিদ আজাদ, প্রকাশক-শিল্পতরু প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮৬।
৯। বৈদগ্ধ পত্রিকা (জীবনানন্দ সংখ্যা), অক্টোবর, ১৯৯৯।
১০। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড (পরিমার্জিত তৃতীয় সংস্করণ), অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ২০০৪।
১১। সংসদ বাংলা সাহিত্যসঙ্গী, সংকলন ও সম্পাদনা: শিশিরকুমার দাশ, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ২০০৩।
১২। বঙ্গসাহিত্যাভিধান, প্রথম খণ্ড, হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, ফার্মা কেএলএম প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৯০।
Post Views: 4

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Recent Posts

  • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের  ছোটগল্পে আঙ্গিকে ফ্রয়েডীয় চিন্তার স্বরূপ
  • টার্ম পেপার-3 রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবে কপালক্ণ্ডুলার সার্থকতা আলোচনা কর’
  • ত্রিশোত্তর কালের কবি জীবনানন্দ দাশের কাব্য প্রতিভার স্বরপ বিশ্লেষণ। টার্ম পেপার-2
  • গেছে দেশ দুঃখ নাই, আবার তোরা মানুষ হ!
  • কাজী নজরুল ইসলামের প্রবন্ধ রাজবন্দীর জবানবন্দী

Most Viewed Posts

  • রোমান্টিক উপন্যাস হিসেবে কপালকুণ্ডলা এর সার্থকতা আলোচনা কর । 211003 (475)
  • কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের অবলম্বনে নবকুমার চরিত্রটি আলোচনা কর। 241003 (386)
  • SSC Result 2022 with Marksheet – All Education Boards (376)
  • জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স শেষ পর্বের সিলেবাস-2022 (353)
  • চর্যাপদ এর সমাজচিত্র আলোচনা কর। 231001 (350)
  • আলাওলের পদ্মাবতী কাব্য অবলম্বনে সিংহল দ্বীপের বর্ণনা দাও। 221003 (340)
  • বিসর্জন নাটকের জয়সিংহ চরিত্রটি বিশ্লেষণ কর। 22100 (325)
  • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এর ডাইনি গল্পের বিষয়বস্তু আলোচনা কর।Nu Bangla 231005 (319)
  • উপভাষার শ্রেণিবিভাগ ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো। (308)
  • কাহিনিকাব্য হিসেবে নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যের সার্থকতা আলোচনা কর। (305)

Archives

  • December 2025 (3)
  • November 2025 (1)
  • September 2025 (6)
  • May 2025 (2)
  • March 2025 (1)
  • November 2022 (1)
  • September 2022 (2)
  • June 2022 (5)
  • March 2022 (1)
  • February 2022 (10)
  • January 2022 (40)
  • December 2021 (86)

Categories

  • Uncategorized
  • অনান্য
  • অনার্স ১ম বর্ষ
  • অনার্স ২য় বর্ষ
  • অনার্স ৩য় বর্ষ
  • অনার্স ৪র্থ বর্ষ
  • অনুবাদে চিরায়িত সাহিত্য
  • এমফিল/পিএইচডি
  • চাকরির প্রস্তুতি
  • টামপেপার
  • ট্রামপেপার
  • ধ্বনিবিজ্ঞান ও ভাষাতত্ত্ব
  • পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যের সমালোচনা পদ্ধতি
  • পিএইডি
  • প্রশ্ন ব্যাংক
  • প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিতা
  • বাংলা উপন্যাস
  • বাংলা উপন্যাস-১
  • বাংলা উপন্যাস-২
  • বাংলা উপন্যাস-৩
  • বাংলা কবিতা
  • বাংলা কবিতা-১
  • বাংলা কবিতা-২
  • বাংলা ছোটগল্প
  • বাংলা ছোটগল্প-১
  • বাংলা ছোটগল্প-২
  • বাংলা নাটক
  • বাংলা নাটক-১
  • বাংলা প্রবন্ধ
  • বাংলা প্রবন্ধ-১
  • বাংলা ভাষার ইতিহাস ও ব্যবহারিক বাংলা
  • বাংলা রম্য ও ভ্রমণ সাহিত্য
  • বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-১
  • বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-২
  • বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-৩
  • বাংলাদেশ, বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতি
  • বাংলাদেশের সাহিত্য
  • ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য
  • মধ্য যুগের কবিতা
  • মাস্টার্স
  • রূপতত্ত্ব, রসতত্ত্ব, ছন্দ, অলংকার
  • সাজেশন্স
  • সিলেবাস
  • স্বাধীন বাংলার অভূদয়ের ইতিহাস
© 2025 Nu Bangla | Powered by Superbs Personal Blog theme