Skip to content
Nu Bangla
Menu
  • অনার্স ১ম বর্ষ
    • বাংলাদেশ, বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতি
    • বাংলা ভাষার ইতিহাস ও ব্যবহারিক বাংলা
    • বাংলা কবিতা-১
    • বাংলা উপন্যাস-১
    • স্বাধীন বাংলার অভূদয়ের ইতিহাস
  • অনার্স ২য় বর্ষ
    • বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-১
    • মধ্য যুগের কবিতা
    • বাংলা কবিতা-২
    • বাংলা নাটক-১
  • অনার্স ৩য় বর্ষ
    • বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-২
    • প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিতা
    • বাংলা ছোটগল্প-১
    • ফোকলোরতত্ত্ব ও বাংলা লোকসাহিত্য
    • রূপতত্ত্ব, রসতত্ত্ব, ছন্দ, অলংকার
    • বাংলা প্রবন্ধ-১
    • বাংলা রম্য ও ভ্রমণ সাহিত্য
    • বাংলা উপন্যাস-২
  • অনার্স ৪র্থ বর্ষ
    • বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-৩
    • বাংলা উপন্যাস-৩
    • বাংলা ছোটগল্প-১
    • পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যের সমালোচনা পদ্ধতি
    • অনুবাদে চিরায়িত সাহিত্য
    • বাংলা ছোটগল্প-২
    • বাংলা কবিতা-৩
    • ধ্বনিবিজ্ঞান ও ভাষাতত্ত্ব
    • মৌখিক
  • মাস্টার্স
    • বাংলা কবিতা
    • বাংলা উপন্যাস
    • বাংলা ছোটগল্প
    • বাংলা নাটক
    • বাংলা প্রবন্ধ
    • বাংলাদেশের সাহিত্য
    • ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য
    • মৌখিক
    • টামপেপার
    • এমফিল/পিএইচডি
    • সাজেশন্স
    • চাকরির প্রস্তুতি
    • প্রশ্ন ব্যাংক
Menu
টার্ম পেপার

টার্ম পেপার-3 রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবে কপালক্ণ্ডুলার সার্থকতা আলোচনা কর’

Posted on December 4, 2025 by সালেক শিবলু

বাংলা বিভাগ
এম.এ শেষ বর্ষ
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা
টার্ম পেপার : ২০১৬

টার্ম পেপার
শিরোনাম : ‘ রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবে কপালক্ণ্ডুলার সার্থকতা আলোচনা কর’

উপস্থাপনায়

মো. বাবুল হোসাইন
বাংলা বিভাগ, এম.এ শেষ বর্ষ
রোল নম্বর : ১৩১৩৩
শিক্ষাবর্ষ: ২০১৩-১৪
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা

তত্ত্বাবধায়ক

মো. আশরাফুল ইসলাম
প্রভাষক, বাংলা বিভাগ
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা

 

ঘোষণাপত্র

আমি এই মর্মে ঘোষণা করছি যে “রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবে কপালক্ণ্ডুলার সার্থকতা ” শীর্ষক গবেষণা পত্রটি আমার নিজস্ব রচনা। ইতঃপূর্বে এই গবেষণা কর্মটি বা এর অংশ বিশেষ অন্য কোথাও প্রকাশিত হয়নি।

 

 

 

 

 

 

 

আব্দুল হান্নান সরকার
বাংলা বিভাগ, এম.এ শেষ বর্ষ
রোল নম্বর : ১৩১৩০
শিক্ষাবর্ষ: ২০১৩-১৪
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা

 

 

 

 

 

মুখবন্ধ

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী, মৌলিক ও বিস্ময়কর, প্রতিভার অধিকারী ছিলেন বাংলা সাহিত্যের সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর অবস্থান ছোট করে দেখার উপায় নেই। প্রকৃত অর্থে বাংলা উপন্যাসের চিরায়ত ধারা তাঁর হাতে পূর্ণতা পেয়েছিল ।

তাই তাঁর বিষয়টি বাংলা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট গবেষণা হওয়ার দাবি রাখে । এর অংশ হিসেবে এম.এ শেষ বর্ষের পাঠ্যসূচির অর্š—ভূক্ত টার্ম পেপার প্রস্তুত কর্মটি একটি ক্ষুদ্র গবেষণা হলেও বাংলা বিভাগের প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে চিহ্নিত। টার্ম পেপার গবেষণার জন্য আমার নির্ধারিত বিষয় হলো “রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবে কপালক্ণ্ডুলার সার্থকতা ” এই গবেষণা কর্মটি ধারাবাহিকতা বা যথার্থতার প্রশ্নে কতটা উত্তীর্ণ হয়েছে বা হয়নি তার চেয়ে বড় কথা গবেষণার মাধ্যমে রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবে কপালক্ণ্ডুলার সার্থকতা এর কিছু চিত্র খুঁজে পেয়েছি। তবুও সকল দিক বিবেচনা করলে গবেষণা কর্মটি যথাযোগ্য মূল্যায়ন হবে বলে আমার বিশ্বাস।

আব্দুল হান্নান সরকার
বাংলা বিভাগ, এম.এ শেষ বর্ষ
রোল নম্বর : ১৩১৩০
শিক্ষাবর্ষ: ২০১৩-১৪
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা

 

 

 

 

 

 

 

কৃতজ্ঞতা স্বীকার

 

 

 

একজন শিক্ষার্থীর কাছে একটি গবেষণা কাজ সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করা কঠিন একটি বিষয়। এজন্য প্রয়োজন নির্দেশনা ও পরামর্শ। পাঠ্যক্রমের গুরত্বপূর্ন এবং একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে এম.এ শেষ ক্ষর্ষের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষার্থীদের আবশ্যকীয় বিষয় হিসেবে একটি গবেষণা ধর্মী টার্ম পেপার প্রস্তুত করতে হয়। আমি প্রথমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি টার্ম পেপার প্রস্তুত কমিটির সভাপতি ও বাংলা বিভাগের সম্মানিত বিভাগীয় প্রধান জনাব প্রফেসর মহা: আব্দুর রাজ্জাক স্যারের প্রতি ।
তারপর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আমার এই গবেষণা কর্মের তত্ত্বাবধায়ক আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জনাব মো. আশরাফুল ইসলাম স্যারের প্রতি; যিনি আমার টার্ম পেপারের শিরোনাম নির্ধারণকরে দেন এবং আমাকে প্রয়োজনীয় সকল পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা দিয়ে এই গবেষণার কাজটি সফল করতে অন্যতম ভূমিকা রেখেছেন। এর জন্য আমি আবারও তাঁকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।

আব্দুল হান্নান সরকার
বাংলা বিভাগ, এম.এ শেষ বর্ষ
রোল নম্বর : ১৩১৩০
শিক্ষাবর্ষ: ২০১৩-১৪
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা

 

 

 

 

তত্ত্বাবধায়কের ঘোষণা

 

 

‘আমি এই মর্মে ঘোষণা করছি যে, সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা এর বাংলা বিভাগের এম.্্এ শেষ বর্ষের ছাত্র আব্দুল হান্নান সরকার কর্তৃক “রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবে কপালক্ণ্ডুলার সার্থকতা ” শীর্ষক গবেষণাপত্রটি একটি গবেষণামূলক কাজ। এই গবেষণা পত্রটি আমি পড়েছি। এই গবেষণা লব্ধ বিষয়ের প্রতি আমি সন্তষ্ট । এই গবেষণাটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে বাংলা বিভাগের এম.এ শেষ বর্ষ এর চুড়ান্ত পরীক্ষার স্বার্থ পূরণার্থে গবেষক আমার তত্ত্ববধানে সম্পন্ন করেছে’ ।

 

 

 

তত্ত্বাবধায়ক

মো. আশরাফুল ইসলাম
প্রভাষক, বাংলা বিভাগ
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা

 

 

অনুমোদনপত্র

 

 

 

আব্দুল হান্নান সরকার কর্তৃক “রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবে কপালক্ণ্ডুলার সার্থকতা ” শীর্ষক গবেষণাপত্রটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ শেষ বর্ষের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পাঠ্যক্রমের সম্পূরক হিসেবে অনুমোদন করা হল ।

 

 

 

তত্ত্বাবধায়ক

মো. আশরাফুল ইসলাম
প্রভাষক, বাংলা বিভাগ
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা

 

 

 

 

সূচিপত্র

শিরোনাম পৃষ্ঠা
১. ভূমিকা ০৭
২. প্রারম্ভিক জীবন ০৮
৩. শিক্ষা ০৯
৪. কর্মজীবন ১০
৫. মৃত্যু ১০
৬. সাহিত্য প্রতিভা ১১
৭. বঙ্কিম সহিত্যের ধারা ১২
৮. রোমান্স হিসাবে কপালকুন্ডলা ১৫
৯. সার-সংক্ষেপ ২৪
১০. সহায়ক গ্রন্থ ২৫

 

 

 

 

ভুমিকা

 

 

বাংলা উপন্যাসের সাহিত্যের অন্যতম স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । এ যাবৎকালে বিশ্বের চার জন শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকের এক জন তিনি। বাংলা সাহিত্যের বিকাশে ঔপন্যাসিক বঙ্কিমের আবেদন অনেক বেশি এবং তিনি বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে সম্রাটের মহিমায় বিরাজমান। বঙ্কিম প্রতিভার নিকট কোন বিষয়ই বঞ্চিত হয়নি।

তার রচিত চরিত্রগুলোতে একদিকে অন্ধ বিশ্বাস অন্যদিকে সামাজিক বৈষম্যও ধর্ম বৈষম্যের ক্ষেত্রে অবিচার সম্পর্কে তার কঠিন যুক্তি প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলা উপন্যাসের যথার্থ এক স্রষ্ঠা বঙ্কিমচন্দ্র তার দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫) রাজপথ বেয়ে শুধু এক অশ্বারোহী রাজপুরুষের আগমন ঘটেছে, বাংলা উপন্যাসের ঘটে সফল প্রতিষ্ঠা। এবং তার হাতে বাংলা উপন্যাসে যে শীর্ষ উপনীত হয় তা দীর্ঘকাল পরেও একবিংশ শতকে অনতিক্রমনীয় হয়ে আছে। তার সময়ে এবং তার পরে বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের ধারায় কত শক্তিশালী ঔপন্যাসিক আর্বিভূত হয়েছে-রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তরাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মানিকে বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। এরা ঔপন্যাসিক রূপে প্রত্যেকেই কীর্তিমান নিঃসন্দেহ-স্ব-স্ব বৃত্তে। বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাস জগতে সম্রাটের মহিমায় আসীন আছেন এবং তার সেই গৌরব আজ অবধি কেউ ক্ষুন্ন করতে পারেনি-এ কথা নিঃসংকোচে বলা যায়।

তাই স্বাধীন ও সাবভৌম বাংলাদেশে যে দেশের প্রতিষ্ঠা ভাষাভিত্তিক সে দেশে বঙ্কিমের অধিকতর সমাদর হবে এই প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।

 

 

 

প্রারম্ভিক জীবন

এক একজন মানুষ থাকেন যাঁরা তাঁর সময়ের সৃষ্টি। একটা জাতির জীবনধারা যখন এক মহতি পরিবর্তনের বাঁকে এসে দাঁড়ায় তখন সেই ক্রান্তিমুহূর্তটি নিজেরই প্রয়োজনে কিছু মানুষকে গড়ে নেয় যাঁরা সেই পরিবর্তিত পথে জাতিকে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন। পথহীন দিক চিহ্নহীন নতুন প্রান্তরের মধ্যে দুপা এগিয়ে গিয়ে জমি কেটে পথ গড়েন ও সেইসঙ্গে জাতির হাতে তুলে দেন সেই পথে এগিয়ে যাবার ভবিষ্যতের পাথেয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এমনুই একজন মানুষ ছিলেন।
নবজাগরণের মুখে দাঁড়ানো ভারতবাসী যখন দীর্ঘকালের পরিচিত এক জীবনধারাকে ছেড়ে এক নতুন জীবনের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই ক্রান্তি মুহূর্তে যে ক’জন মানুষ তাকে নতুন পথ দেখিয়েছেন ইনি তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। বাঙলাকে তিনি দিয়ে গিয়েছেন নতুন যুগের নতুন জীবনকে লিপিবদ্ধ করবার উপযোগী নয়া সাহিত্যধারা ও সাহিত্যভাষা, নবজাগ্রত দেশপ্রেমকে ভাষা দিয়েছেন মাতৃপূজার নতুন মন্ত্র বন্দেমাতরম তৈরি করে।
জন্ম পশ্চিমবঙ্গের নৈহাটির কাঁঠালপাড়া গ্রামে, ২৭ শে জুন ১৮৩৮ সালে । পড়াশোনা হুগলী মোহসীন কলেজে ও প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৮৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। নব প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে সেদিন যারা গ্রাজুয়েট হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন বঙ্কিচন্দ্র তাঁদের একজন। ১৮৫৮ সালে বি এ পাশ করে তিনি ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন । বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম বিয়ে হয় ১৮৪৯ সালে, ১১ বছর বয়সে। নারায়ণপুর গ্রামের এক পঞ্চমবর্ষীয়া বালিকার সাথে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু চাকুরি জীবনের শুরুতে যশোর থাকাকালীন ১৮৫৯ সালে প্রথমা পত্নীর মৃত্যুর পর ১৮৬০ সালের জুন মাসে হালিশহরের বিখ্যাত চৌধুরী বংশের কন্যা রাজলক্ষী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।

তখনকার অন্যন্য লেখকের মত তিনিও প্রথমে ইংরেজীতে সাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এই প্রচেষ্টার প্রথম নিদর্শন স্বরূপ ” রাজমোহন’স ওয়াইফ” (১৮৫২) নামক উপন্যাসটি রচনা করেন। পরে বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু করেন। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস “দুর্গেশনন্দিনী” রচনার মাধ্যমে বাঙলার সাহিত্যধারাকে গদ্যের জমিনে শক্তভাবে শেকড় ছড়িয়ে দাঁড় করাবার কাজে হাত দেন তিনি। গদ্য ভাষা নিয়ে তখন কিছু কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা চলছিল বটে, কিন্তু বঙ্কিমযুগের সূচনা সেই উদ্যমকে জনপ্রিয়তার একটা শক্ত ভিত্তি দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। উপন্যাসের পাশাপাশি অজস্র গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ও কমলাকান্তের দফতর কিংবা মুচিরাম গুড়-এর মত রসরচনার মধ্যে দিয়ে তিনি সেই দিকপরিবর্তনের ক্রান্তিযুগটিতে বাঙালির জীবন, সমাজ ও দর্শনের রূপটির ওপরে একটি প্রয়োজনীয় তথ্যভাণ্ডার গড়ে রেখে গিয়েছেন উত্তরসূরীদের জন্য। সেই ভাণ্ডারেরর গর্বিত উত্তরাধিকারী আমরা।

শিক্ষা

 

জন্মের পর ছয় বছর বঙ্কিমচন্দ্র কাঁটালপাড়াতেই অতিবাহিত করেন। পাঁচ বছর বয়সে কুল-পুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেখড়ি হয়। শিশু বয়সেই তাঁর অসামান্য মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্কিমের সহোদর পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “শুনিয়াছি বঙ্কিমচন্দ্র একদিনে বাংলা বর্ণমালা আয়ত্ত করিয়াছিলেন।” যদিও গ্রামের পাঠশালায় বঙ্কিম কোনও দিনই যান নি। পাঠশালার গুরুমশাই রামপ্রাণ সরকার বাড়িতে তাঁর গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা থেকে মনে হয় তিনি রামপ্রাণের শিক্ষা থেকে বিশেষ উপকৃত হন নি। তিনি লিখেছেন, “সৌভাগ্যক্রমে আমরা আট দশ মাসে এই মহাত্মার হস্ত হইতে মুক্তিলাভ করিয়া মেদিনীপুর গেলাম।”

বাড়িতেই গ্রাম্য পাঠশালায় গুরুর কাছে কয়েক মাস লেখাপড়ার পরে বঙ্কিমচন্দ্র বাবার কর্মস্থলে গিয়ে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন। পরে তিনি কাঁঠালপাড়ায় এসে হুগলি কলেজে ভর্তি হন। সে বছর তার বিয়ে হয়। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথমা স্ত্রী মারা গেলে তিনি পুনরায় বিয়ে করেন। বঙ্কিমচন্দ্র অপুত্রক ছিলেন, তার তিনটি কন্যাসন্তান ছিল। ছাত্রজীবনে বঙ্কিমচন্দ্রের মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। কাঁঠালপাড়ায় তিনি সংস্কৃত নিয়ে পড়াশুনা করেন, সঙ্গে বাংলা ভাষার চর্চাও করতেন। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি আইন পড়বার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। আইন পড়া শেষ হওয়ার আগেই তিনি পেশাজীবনে প্রবেশ করেন।

১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র নেঁগুয়ায় (কাঁথি) বদলি হন। এখানেই কপালকুণ্ডলা কাহিনির উৎপত্তি। সে বছরই তাকে খুলনা বদলি করা হয়। খুলনার মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তিনি শক্ত হাতে নীলকর সাহেবদের দৌরাত্ম দমন করেছিলেন। কর্মক্ষেত্রে তিনি ন্যায়নিষ্ঠ, নির্ভীক, কর্তব্যপরায়ণ, সুযোগ্য শাসক ও বিচারক ছিলেন। ইংরেজ সরকার তাকে শেষজীবনে রায়বাহাদুর এবং সিআইই উপাধিতে ভূষিত করেন। তেত্রিশ বছর সরকারি চাকরি করার পর ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর বঙ্কিমচন্দ্র অবসর গ্রহণ করেন। শেষ জীবন তিনি কলকাতায় নিজ বাড়িতে কাটিয়েছেন। সেখানেই বহুমুত্র রোগে ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ৮ এপ্রিল তার মৃত্যু হয়।

বঙ্কিমচন্দ্রের জীবন দীর্ঘ নয়। এ সময়ের মধ্যে তার সাহিত্য সাধনা বিস্ময়কর। হুগলি কলেজে ছাত্রজীবনে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের রচনার আদর্শে সংবাদ প্রভাকর’ এবং ‘সংবাদ সাধুরঞ্জন’-এ গদ্য, পদ্য লিখতেন। ৪২ বছরের সাহিত্যসাধনা তার ছাত্রজীবন, কর্মজীবন, শেষজীবন পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে তিনি শেষ লেখা লেখেন। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৩৪। ১৫ বছর বয়সে তিনি দুটি ছোট কাব্য রচনা করেন। তিন বছর পরে কাব্য দুটি ‘ললিতা-পুরাকালিক গল্প তথা মানসদ নামে প্রকাশিত হয়।
১৮৪৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র পিতার কর্মস্থল মেদিনীপুরে আনীত হলে, সেখানেই তাঁর প্রকৃত শিক্ষার সূচনা হয়। মেদিনীপুরের ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনৈক এফ টিডের পরামর্শে যাদবচন্দ্র শিশু বঙ্কিমকে তাঁর স্কুলে ভর্তি করে দেন। এখানেও বঙ্কিম অল্পকালের মধ্যেই নিজ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। পূর্ণচন্দ্রের রচনা থেকে জানা যায়, বার্ষিক পরীক্ষার ফলে সন্তুষ্ট হয়ে টিড সাহেব বঙ্কিমকে ডবল প্রমোশন দিতে উদ্যত হলে যাদবচন্দ্রের হস্তক্ষেপে তিনি নিরস্ত হন। ১৮৪৭ সালে টিড ঢাকায় বদলি হয়ে গেলে সিনকেয়ার তাঁর স্থলাভূষিক্ত হন; তাঁর কাছেও বঙ্কিম প্রায় দেড় বছর ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেন।

১৮৪৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্র পুনরায় কাঁটালপাড়ায় ফিরে আসেন। এইসময় কাঁটালপাড়ার শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে বঙ্কিম বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ নেন। বঙ্কিমচন্দ্র খুব ভালো আবৃত্তিকারও ছিলেন। সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জন নামক সংবাদপত্রে প্রকাশিত বহু কবিতা তিনি এই বয়সেই কণ্ঠস্থ করে ফেলেন। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর বিরচিত বিদ্যাসুন্দর কাব্য থেকে বিদ্যার রূপবর্ণন ও জয়দেব প্রণীত গীতগোবিন্দ্র কাব্য থেকে ধীরে সমীরে যমুনাতীরে কবিতাদুটি তিনি প্রায়শই আবৃত্তি করতেন। এছাড়াও পণ্ডিত হলধর তর্কচূড়ামণির কাছে এই সময় তিনি মহাভারত শ্রবণ করতেন। হলধরই তাঁকে শিক্ষা দেন – “শ্রীকৃষ্ণ আদর্শ পুরুষ ও আদর্শ চরিত্র”। এই শিক্ষা তাঁর পরবর্তী জীবনে রচিত নানা রচনাতে প্রতিফলিত হয়েছিল।

কিছুকাল পরে ১৮৪৯ সালে হুগলি কলেজে ভর্তি হন। এখানে তিনি সাত বছর পড়াশোনা করেন। হুগলি কলেজ পড়াকালীন ১৮৫৩ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে মাসিক আট টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বছরেই সংবাদ প্রভাকরে কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কুড়ি টাকা পুরস্কার লাভ করেন। হুগলি কলেজ অধ্যয়নকালেই বঙ্কিমচন্দ্র কবিবর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জনে গদ্য-পদ্য রচনা আরম্ভ করেন। পরবর্তীকালে তাঁর বহু রচনা এই দুই কাগজে প্রকাশিত হয়। হুগলি কলেজ ১৮৫৬ সালে সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় সব বিষয়ে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করে তিনি দুই বছরের জন্য কুড়ি টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বছরই তিনি হুগলি কলেজ ছেড়ে আইন পড়বার জন্য কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৫৭ সালে জানুয়ারী মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা প্রবর্তন করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের আইন বিভাগ থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরের বছর ১৮৫৮ সালে প্রথমবারের মতো বি.এ. পরীক্ষা নেওয়া হয়। মোট দশজন ছাত্র প্রথমবারে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কেবলমাত্র বঙ্কিমচন্দ্র ও যদুনাথ বসু।

 

 

কর্মজীবন

তার বাবার মতো তিনিও সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর পদে। সারা জীবন তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যান। স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে দুটি খেতাবে ভূষিত করে – ১৮৯১ সালে রায় বাহাদুর খেতাব এবং ১৮৯৪ সালে কম্প্যানিয়ন অফ দ্য মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার খেতাব। তবে সরকারি কর্মকর্তা নয় বরং লেখক এবং হিন্দু পুনর্জাগরণের দার্শনিক হিসেবেই তিনি অধিক প্রখ্যাত।

মৃত্যু
শেষ জীবনে তাঁর স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো ছিল না। ১৮৯৪ সালের মার্চ মাসে তাঁর বহুমূত্র রোগ বেশ বেড়ে যায়। এই রোগেই অবশেষে তাঁর মৃত্যু হয়, এপ্রিল ৮, ১৮৯৪ (বাংলা ২৬ চৈত্র ১৩০০ সাল)।

সাহিত্য প্রতিভা

বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য প্রতিভা ছিলো অসাধারন। হুগলী কলেজে ছাত্র থাকতেই তার সাহিত্য প্রতিভার স্ফুরন ঘটে। আরও বোঝা যায় তিনি গুরুত্বপূর্ন সরকারি কর্মে নিযুক্ত থেকেও এতো গুলো উপন্যাস লিখেছেন এই থেকে বোঝা যায় তিনি কত মেধাবী ছিলেন। কিশোর বয়সে কবিতা লিখে তিনি ঈশ্বর চন্দ্রের গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধু রঞ্জনের পত্রিকায়। সংবাদ প্রভাকরে তার চৌদ্দ বছর বয়সে লেখা গদ্য ও প্রবন্ধ ও প্রকাশিত হয়।
সেই থেকে শুরু হয় তার লেখা। তার প্রথম লেখা কাব্যগ্রন্থ ললিতা তথা মানস (১৮৫৬)। দূর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫) তার প্রথম উপন্যাস এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস। দ্বিতীয় উপন্যাস হল কপালকুন্ডুলা (১৮৬৬) এটি একটি রোমান্স ধর্মী উপন্যাস। তার রাজনৈতিক উপন্যাস মৃণালিনী (১৮৬৯)। সামাজিক সমস্যার আলোকে রচিত উপন্যাস বিষবৃক্ষ (১৮৭৩) কৃষ্ণ কান্তের উইল (১৮৭৮) মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ মূলক উপন্যাস রজনী (১৮৭৭) হিন্দুর বাহুবল ও বীরত্ব রূপায়িত হয়েছে রাজসিংহ (১৮৮২) আনন্দমঠ (১৮৮২) উপন্যাস।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস রাজমোহন ওয়াইফ ইংরেজিতে লেখা। তিনি ছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাবাদর্শের সমন্বয় সাধনকারী তেমনি বাংলা ভাষার তুলনমূলক সমালোচনা ধারর পথ প্রদর্শক তিনি প্রবন্ধ রচনা করে অসাধারণ মেধার পরিচয় দিয়েছেন তার প্রবন্ধ গুলো হল লোকরহস্য (১৮৭৪) কমলাকান্তের দপ্তরে (১৮৭৫) বিধি সমালোচনা (১৮৭৬) সাম্য (১৯৭৯) কৃষ্ণচরিত্র (১৯৮৬) ধর্মতত্ত্ব অনুশীলন (১৮৮৮)। কমলাকান্তের দপ্তর প্রবন্ধ লিখে কমলাকান্ত ছদ্ম নাম ধারণ করেন। এই থেকে তার ছদ্ম নাম হয় কমলাকান্ত। তিনি সাহিত্যের রসবোদ্ধাদের কাছ থেকে সাহিত্য সম্র্রাট আখ্যা লাভ করেন। বঙ্কিম চন্দ্রের অন্যতম অবদান বঙ্গাদর্শন (১৮৭২) এই পত্রিকাটির প্রকাশ ও সম্পাদনা।

বঙ্কিম সহিত্যের ধারা

বাংলা সাহিত্যের সম্রাট হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্রের অবস্থান ছোট করে দেখার উপায় নেই। প্রকৃত অর্থে বাংলা উপন্যাসের চিরায়ত ধারা যার হাতে পূর্ণতা পেয়েছিল তিনিই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ইংরেজি ভাষায় দক্ষ বঙ্কিমচন্দ্র ‘জধলসড়যধহদং ডরভব’ নামে ইংরেজিতে একটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দুর্গেশনন্দিনী দিয়েই তার সাহিত্য জীবনের সূচনা। এই উপন্যাস দিয়েই বঙ্কিমচন্দ্র নতুন এক দিগন্ত খুলে দিলেন। বাঙালির রোমান্টিক সত্তার এক নতুন জাগরণ ঘটল তার উপন্যাসে। বঙ্কিমচন্দ্রের এমন তিনটি উপন্যাস হলো, দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুণ্ডলা এবং মৃণালিনী। এরপর বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভার স্ফূরণ দেখা গেল ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার প্রকাশনা ও সম্পাদনার মাধ্যমে। এই মাসিকপত্রে তিনি পরপর বিষবৃক্ষ, ইন্দিরা, যুগলাঙ্গ্গুরীয়, চন্দ্রশেখর ইত্যাদি উপন্যাসের পাশাপাশি নানা বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে লোকরহস্য, বিজ্ঞানরহস্য, কমলাকান্তের দপ্তর, সাম্য প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

বঙ্গদর্শনের আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যে যুগান্তর এনেছিল। সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্রের বিশিষ্ট অবদান হলো প্রবন্ধ ও সমালোচনা সাহিত্যের বিকাশ ও বিস্তার। দুই বছর বন্ধ থাকার পর সঞ্জীবচন্দ্রের সম্পাদনায় ‘বঙ্গদর্শন’ পুনরায় প্রকাশিত হয়। রাধারাণী, রজনী, কৃষ্ণকান্তের উইল এই যুগের রচনা। বাংলা উপন্যাসের সূত্রপাত ও এপিকধর্মী বাংলা উপন্যাসের জনক হলেও তিনি সমালোচকদের কাছে আজও সমালোচিত। আজও তাকে সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট করা হয়। এ জন্য অনেকে সংস্কৃত শব্দের অতি ব্যবহারকেও এককভাবে দায়ী বলে মনে করেন। অথচ এই বঙ্কিমচন্দ্রই ‘সাম্য’ রচনা করেছিলেন। তিনি সে সময়ে এমন একটি বই রচনা করেছিলেন তিনি সাম্প্রদায়িক হন কি করে? ‘যবন’, ‘ন্যাড়া’ এ শব্দগুলো যদি উপন্যাসের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে হয় তাহলে তিনি সেই দোষে ফেরারী হবেন কেন?

ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাসগুলোতেও তাকে অনেক সমালোচক খাটো করার চেষ্টা করেন। তার ‘সীতারাম’ নিয়ে বহু কথা প্রচলিত আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, উপন্যাস আর ইতিহাসের বই এক নয়। বঙ্কিমের সীমাবদ্ধতা তার উপন্যাসের চরিত্রে। তার চরিত্র বড়ও হয়নি, ছোটও হয়নি- বামুন রয়ে গেছে। এত বড় ঔপন্যাসিকের জন্য এটা কোন সংকট নয়। এর প্রমাণ বঙ্কিম চর্চা কমেনি বরং সময়ের সঙ্গে বেড়েছে।‘বঙ্কিমচন্দ্র সাম্প্রদায়িক’ যারা বলেন তারা কতোটা বঙ্কিম পাঠ করেছেন তাও বিবেচ্য বিষয়।

বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যযুগের রচনায় দেখা যায় সৌন্দর্য ও লোকশিক্ষার মিলন। শেষ যুগে লোকশিক্ষার প্রাধান্য। প্রতিভার শেষ ধাপে প্রকাশিত পত্রিকা নবজীবন ও প্রচার। এই যুগের প্রধান উপন্যাস রাজসিংহ, আনন্দমঠ দেবী চৌধুরাণী, সীতারাম। দেবী চৌধুরাণী আংশিকভাবে বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হয়। সীতারাম প্রচারে প্রকাশিত হয়। তার অনেক উপন্যাসই তিনি বারবার নতুনভাবে লিখেছেন বা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছেন। এর দৃষ্টান্ত হলো ইন্দিরা, রাজসিংহ ও কৃষ্ণকান্তের উইল।

বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভার শেষ পর্যায় পূর্ণভাবে প্রকাশ পায় স্বাদেশিকতা ও অনুশীলন ধর্মের ব্যাখ্যার মাধ্যমে। কমলাকান্তের দপ্তর’র নায়ক নেশাখোর কমলাকান্তের মুখে মাতৃপ্রেমের প্রথম প্রকাশ আনন্দমঠ’র বন্দেমাতরম মন্ত্রে যেন পূর্ণ প্রতিষ্ঠা পেল। অনুশীলন তার ধর্মমূলক প্রবন্ধ। এ ধরনের প্রবন্ধ তিনি একাধিক লিখেছেন। ধর্মের আদর্শ সম্বন্ধে এক প্রবন্ধে লিখেছেন : ‘সকল প্রকার মানসিক বৃত্তির সম্যক অনুশীলন, সম্যক স্ফুর্তি ও যথোচিত উন্নতি ও বিশুদ্ধিই মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য’। এখানে বঙ্কিমচন্দ্র জন স্টুয়ার্ট মিলের শিষ্য ও মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণের অনুগামী। শ্রীকৃষ্ণই অনুশীলন ধর্মের আদর্শ। কৃষ্ণচিত্র প্রথমে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয় প্রচারে।

বঙ্কিমচন্দ্রের প্রায় সব উপন্যাসই ইংরেজি, জার্মান, হিন্দী, কানাড়া, তেলেগু প্রভৃতি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। তার উপন্যাসগুলোর নাট্যরূপ সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চে অভিনীত ও সিনেমায় রূপায়িত হয়েছে। উপন্যাসগুলোর নাটকীয়তা ও রোমান্টিকতা সাফল্যের একটা কারণ। ঐতিহাসিক উপন্যাসের বিস্তৃত আঙিনায় বাঙালির রোমান্টিক মনকে প্রথমে মুক্তি দিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। ভাষা ও উপন্যাসের কাঠামো তৈরির বিষয়ে তিনি পথ দেখিয়েছিলেন। দেশের রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয়, সামাজিক ও শিক্ষামূলক উন্নতির জন্য তিনি অবিরাম লিখেছেন। আনন্দমঠ’র বন্দেমাতরম মন্ত্র ভারতবর্ষে অপূর্ব দেশপ্রীতির উদ্ভব ঘটিয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র কেবলমাত্র সাহিত্যিক বা লেখক নন, উপরন্ত তিনি যুগস্রষ্টা। ঐতিহাসিক, রোমান্টিক, পারিবারিক- এই তিন ধারায় উৎসারিত বঙ্কিমচন্দ্রের আখ্যানগুলোর সমসাময়িক ও পরবর্তী সাহিত্য ও জীবনের ওপর অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করেছে। রাসভারী, গম্ভীর লোক হলেও বন্ধুবৎসলতার গুণে সুধীবৃন্দের সমাবেশে উন্নত রুচি, পরিচ্ছন্ন, সুদর্শন বঙ্কিমচন্দ্র প্রতিভার দীপ্তচ্ছটায় বাংলা সাহিত্যের আকাশ সমুজ্জ্বল রেখেছিলেন।

রোমান্স হিসাবে কপালকুন্ডলা

বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলো সাধারণত রোমান্স বলে পরিচিত এবং কাপালকুণ্ডুলা ও এর ব্যতিক্রম নয়। উপন্যাস এবং রোমান্স এ দু‘য়ের মধ্যে একটি স্পষ্ট রেখা আছে। এবং তা অনুধাবনের বিষয়। অনুধাবনযোগ্য। রূপকথা এ উপন্যাস এ দু‘য়েরই মাঝামাঝি রোমান্স। রূপকথার অসম্ভব কল্পনা উপন্যাসে প্রখর বাস্তব রোমান্স জীবনকে কল্পনা মন্ডিত করে দেখা এক বাস্তবরূপ দানের প্রচেষ্ঠা করা হয়ে থাকে। রোমান্স আমাদের হৃদয়ে এক রহস্যময় আনন্দনুভূতির সঞ্চারণ করে থাকে। এই প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনাগুলো বিচার বিশ্লেষণ না করে তার উদ্দীপনা পূর্ণ দিক , বর্ণনাজ্জ্বল মুহুর্তগুলো নির্বাচন করে তাদের উপরে প্রাত্যহিত জীবনের বিশেষ মুহূর্তের প্রতিকল্পনার আলোক সম্পাত করা হয়ে থাকে। ফলে বাস্তব জীবন তার প্রাত্যহিকতার সীমা অতিক্রম করে বিস্ময় রসে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। এখানে নরনারীর জীবনযাত্রা অপ্রত্যাশিত আনন্দ ও বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ প্রাত্যহিক জীবনে আমরা নরনারীকে বিশেষ এক সীমিত গন্ডীর মধ্যে দেখতে পাই।

সেই সীমার মধ্যে তাদের সুখ দুঃখ, ব্যথা বেদনা আলোড়িত হয় এবং তা অতিক্রান্ত সক্ষম হয় না। কিন্তু রোমান্স তাদের জীবনের বিশেষ বিশেষ মুহুর্তগুলো স্মৃতিময় হয়ে উঠে। প্রাত্যহিকতার গন্ডী অতিক্রম করে যায়। তাই তা আমাদের যে এক কল্পনা প্রবণ মন আছে তাকে তৃপ্ত করে। বিস্ময় রসের উদ্বোধনই রোমান্সের অন্যতম বৈশিষ্ঠ এবং প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য এবং এ জন্য রোমান্স কখনো বর্তমানের পটভূমিতে নয় অতীতের পটভূমিতে রচিত হয়ে থাকে। কেননা যা সুদূরের তা আমাদের বিস্ময়ে অভিভূত করে এবং বিস্ময় রসের সঞ্চার করার জন্যেই রোমান্সে অতীতের জীবনযাত্রা, আচার-ব্যবহার ও রীতিনীতি অঙ্কিত হয়ে থাকে।

শুধু তাই নয় এই বিস্ময় রসের উদ্বোধন করার জন্যই রোমান্সে অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃতের অবতারণা করা হয়ে থাকে। এবং বঙ্কিম চন্দ্রের প্রায় প্রতিটি উপন্যাসে অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত স্থান লাভ করেছে। তার প্রায় উপন্যাসেই সাধু সন্ন্যাসী স্বপ্ন দর্শন, তন্ত্রমন্ত্র ইত্যাদি প্রশ্রয় পেয়েছে। এই জন্য তার উপন্যাসগুলো আমাদের বিস্ময় রসে উদ্বোধিত করে।
এ কথাই ইতিপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে যে রোমান্সে কল্পনার প্রাবল্য ঘটলেও তাকে একটা বাস্তব রূপ দেওয়ার প্রয়াস আছে।

রোমান্স রচয়িতা অতীতের কাহিনীকে বিশ্বাস যোগ্য পরিবেশে স্থাপন করতে চান। ফলে রোমান্সের সাথে বাস্তবের একটা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। উপন্যাসের সাথে রোমান্সের পার্থক্য এখানে যে উপন্যাস বাস্তব জীবনের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কান্বিত কিন্তু রোমান্স কল্পনা স্ফূর্তি লাভ করে। তাই রোমান্সের মধ্যে জীবন ঐশ্বর্যমন্ডিত হয়ে ওঠে এবং উজ্বল বর্ণে প্রতিভাত হয়। রোমান্সে আমাদের রহস্য লোকে নিয়ে যায়। কপালকুন্ডলা (১৮৬৬) বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বিতীয় উপন্যাস। এতে নিগূঢ় ভাবসঙ্গতির জন্য রোমান্স বলা যায়। অরণ্যে এক কাপালিক পালিতা নারী কপালকুন্ডলাকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে।
সামাজিক সংস্কারের সঙ্গে অপরিচিতা এই নারীর নবকুমারের সঙ্গে বিয়ে এবং কপালকুন্ডলার সমাজবন্ধনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এই কাহিনীর মূল ঘটনা। এই উপন্যাসটি প্রকৃতই রোমান্স ধর্মী উপন্যাস কিনা তা আমরা বিশ্লেষণ করবো।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাসের ভিত্তি ভূমি নির্মাণের মাধ্যমে পথ নির্দেশকের ভূমিকা পালন করেছেন এবং বাংলা উপন্যাসকে আধুনিক মানদন্ডে উন্নীত করেছেন। কপালকুন্ডলা বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বিতীয় উপন্যাস। ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত রোমান্সধর্মী এই উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে নতুন দিক উম্মোচনকারী উপন্যাস।

উনিশ শতকে ইউরোপীয় গদ্য রোমান্সের অভিনবত্বের সঙ্গে পরিচয় এবং বঙ্কিমচন্দ্রের মৌলিক সৃজনশীল ক্ষমতার গুণেই বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে কপালকুন্ডলার মতো রোমান্সধর্মী উপন্যাস সৃষ্টি হয়েছে। কপালকুন্ডলা উপন্যাসের রোমান্স ধর্মীতা আলোচনা করতে গিয়ে ড. শ্রী কুমার বন্দোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন “কপালকুন্ডলা রোমান্টিক আবেষ্টন রচনায় বঙ্কিম অদ্ভুত প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ইতিহসা ও প্রেমকে যতদূর সম্ভব পশ্চাতে রাখিয়া রোমান্সের একটি উৎস আবিষ্কার করিয়াছেন, যাহা আমাদের বাস্তব জীবনের কঠিন মৃত্তিকা হইতে স্বতঃই উৎসারিত হইতে পারে”।

কপালকুন্ডুলা উপন্যাসের রোমান্স ধর্মিতা সম্পর্কে আলোচনা করার পূর্বে রোমান্সের যে সাধারন বৈশিষ্ট্য তা উল্লেখ করবে। রোমান্সের বাস্তবতা অপেক্ষাকৃত মিশ্র ধরনের। এতে জীবনের সহজ প্রবাহ অসাধারন উচ্ছাস বা গৌরবময় মূহুর্তগুলোর উল্লেখ থাকে অধিক। জীবনের বিরচিত বিকাশ গুলো মনের উচু বাঁধা ঝরকারগুলো, জীবনের বর্নবহুল শোভাযাত্রা সমারহ এইসবই মুখ্যত রোমান্সের বিষয়বস্তু। এজন্য সুর্যলোক দ্বীপ্ত অতি পরিচিত বর্তমান অপেক্ষাকৃত কুহেলীকাচ্ছন্ন। অপরিচিত অতিতের দিকেই রোমান্সের স্বাভাবিক প্রবনতা। রোমান্স লেখক বাস্তব ও ঐতিহাসিক ভিত্তির উপর সৌধ নির্মান করেন; মন¯ত্তত্ত্ব বিশ্লেষনের দ্বারা কার্য কারণ সম্পর্ক নির্ণয় করেন এবং শিল্পসম্মত সাহিত্য সৃষ্টি করেন।

বঙ্কিমচন্দ্র কপালকুন্ডলা উপন্যাসে রোমান্সের বৈচিত্রময় সমাবেশ ঘটিয়েছেন অত্যন্ত শৈল্পিকভাবে। উপন্যাসটিতে সমুদ্র, মোহনা, উপকুলবর্তী অরন্য, খরস্রোতা নদীর ঢেউয়ে ভেঙ্গে পড়া তটভূমি যেমন আছে, তেমনি আছে কাপালিক পালিত কপালকুন্ডলা এসবই কপালকুন্ডলা উপন্যাসের রোমান্স ধর্মিতার চমৎকার বৈশিষ্ট্য। এ- উপন্যাসের কাহিনী প্রকৃতি রুপ বর্ননা, নায়ক নায়িকার মিলন প্রতিনায়িকার আবির্ভাব পরস্পর পরসাপরের কথোপকথন কাব্যময়তা সবই রোমান্সের বৈশিষ্টর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সর্বপরি কপালকন্ডুলার চরিত্র ও বিকাশ রোমান্সের সর্বাপেক্ষা আকর্ষনীয় দিক।

কপালকুন্ডলা উপন্যাসের আকস্মিকতা রোমান্সের অন্যতম একটি দিক। নবকুমার বনে কাঠ সংগ্রহের জন্য গেলে কপালকুন্ডলার সাথে সাক্ষাত হয়। এ সাক্ষাত নবকুমারের কাছে অত্যান্ত আকস্মিক। অধিকারীর মাধ্যমে নবকুমার ও কপালকুন্ডলার বিয়েও একটি আকষ্মিক ঘটনা। কেননা তাদের মধ্যে প্রেম বা বিয়ে যথোপযুক্ত কারণ ঘটেনি। কপালকুণ্ডলা বাস্তব পক্ষে ব্রাহ্মণ কন্যা কি-না নবকুমারের সাথে তার বিয়ে শাস্ত্র সম্মত কি না এ বিষয়ে নবকুমারের কোনো মাথা ব্যাথা ছিলো না। বিয়ের পর ব্রাহ্মণ ছদ্মবেশীর পত্র হারানো আকষ্মিক ব্যাপারের মধ্যে সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যময়। চিঠি খুঁজতে কপালকুন্ডলার চুল আলুলায়িত হয়েছে এবং ব্রাহ্মণ ছদ্মবেশীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে সেই চুল ব্রাহ্ম বেশীকে স্পর্শ করেছে। দুর হতে নবকুমার কপালকুন্ডলা ব্রাহ্মণ বেশীর কথা শুনতে না পেলেও কপালকুন্ডলার চুল ব্রাহ্মণ বেশীকে স্পর্শ করায় সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে নবকুমার ও কপালকুন্ডলার দাম্পত্য জীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। এরূপ আকস্মিক ঘটনা রোমান্সকে করে তুলেছে শিল্পসম্মত।

কপালকুন্ডলা উপন্যাসের রোমান্স সৃষ্টিতে অলৌকিক দৃশ্যের অবতারনা করা হয়েছে। নবকুমারের সাথে বিয়ের পর কপালকুন্ডলা দেবী পদে বিল্ব পত্র অপর্ণ শুধু একটি পূজার অনুষ্ঠান নয়; এতে কপালকুন্ডলার ভক্তি প্রবণ হৃদয়ে একটি ছায়া ফেলে নতুন জীবনের প্রতি অনাসক্তি বাড়িয়ে দিয়েছে উপন্যাসের দ্বিতীয় খন্ডের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে শ্যাম সুন্দরী ও কপালাকুন্ডের কথপোকথোনের মধ্যে সাংকেতিকতার বর্ননা আছে।

কপালকুন্ডলার চরিত্র পরিকল্পনায় ঔপন্যাসিক রোমান্সের আশ্রয় নিয়েছেন। কপালকুন্ডলা প্রকৃতি পালিত; রহস্যময়ী। কপালকুন্ডলা নির্জন নদী তীরে নবকুমারকে দেখে অবাক হয়নি। কিন্তু পথিমধ্যে মতিবিবিকে অলংকারে সজ্জিত দেখে বিস্মিত হয়েছে। কেননা নারীর সজ্জিত রূপ তার কাছে নতুন। ভিক্ষুক যখন কপালকুন্ডলার কাছে ভিক্ষা চাইলে এবং গহনার দিকে ইঙ্গিত করলো তখন কপালকুন্ডলা কৌটা ভিক্ষুককে দিয়ে দেয়। ভিক্ষুক এরপর রূদ্ধশ্বাসে দৌড়ে চলে যায়…”
এ দৃশ্য দেখে কপালকুন্ডলা ভাবলো-
ভিক্ষুক দৌড়িল কেন ?
এ থেকে কপালকুন্ডলার সংসার সম্পর্কে অনভিঙ্গতা ও বাস্তব জ্ঞান বিবর্জিত মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। নবকুমারের ভালোবাসা নবকুমারের সংসার কোনটিই কপালকুন্ডলাকে মোহবিষ্ঠ করতে পারিনি। পুরাতন জীবন হতে একটি তরঙ্গ আসা মাত্রই একেবারে উদ্মেলিত করে নিয়ে গেছে। কপালকুন্ডলা চরিত্রে এই বৈশিষ্ট্যই কে রোমান্সের উচ্চ শিখিরে নিয়ে গেছে। কপালকুন্ডলা প্রতিপালক কাপালিকের কাছে কোনো লৌকিক আচার শেখেনি। এমনকি অধিকারীর কাছ থেকেও নয়। এদের দ্বারা তার হৃদয়ে ধর্মবিশ্বাস খুব গভীর হয়েছিল মাত্র। এ কারনে কপালকুন্ডলা চারিত্রেক বৈশিষ্টের মধ্যেই রোমান্সের উপাদান নিহিত ছিল।

কপালকুন্ডলা উপন্যাসে রোমান্স সৃষ্টিতে কাপালিক চরিত্র যথেষ্ঠ সহায়তা করছে। কাল্পনিক বেশভূষা, তান্ত্রিক সাধনা এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রোমান্সের আবহ তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। উপন্যাসের কাপালিকের বয়স পঞ্চাশ। গলদেশে রূদ্রাক্ষমালা আয়াত মুখ মন্ডল শ্লশ্রে জুটা পরিবেষ্টিত পরিধানে ব্যাঘ্রচর্ম; তার কেয়া পাতার কুঠিরে রয়েছে আর কয়েকটি ব্যাঘ্র চর্ম।

যে অতিতের পটভূমিতে কপালকুন্ডলা উপন্যাস রচিত সে অতি একান্ত ভাবে বঙ্কিমচন্দ্রের কল্পনা সৃষ্টি এবং এতে তার রোমান্টিক মনো ভঙ্গি সুস্পষ্ঠ। ফলে এ উপন্যাস রোমান্স ধর্মী হয়ে উঠেছে। বস্তুত “কপালকুণ্ডলা” উপন্যাস নয়, কাব্যধর্মী রোমান্স। বাস্তব উপাদনে উপন্যাস গড়ে উঠে অবশ্য রোমান্স বাস্তব সম্পর্ক বিরহিত নয়। রূপকথায় উদ্ভট কল্পনা প্রশয় পেতে পারে যাকে ইংরেজীতে বলা হয় ভধহঃধংঃরপশ, কিন্তু রোমান্সে কেই একটি বাস্তব রূপগ্রাহ্য করা হয়ে থাকে। বঙ্কিমচন্দ্র প্রখর কল্পনা বলে দুর অতিত থেকে উপন্যাসের সকল আহরন করে তাকে রূপ দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন যাতে সহজে পাঠকের প্রতিতী হতে পারে। প্রকৃতি দুহিতা কপালকুন্ডলা অরন্যচারী – নৃশংস কাপালিক আগ্রার রাজপ্রাসাদে মোগল হেরেমে স্বেচ্ছা বিহারিনি মতিবিবি নিতান্ত নিরীহ সজ্জন নবকুমার বর্ধমানে ভাবী সম্রাঙ্গী মেহেরুন্নেসা, এরা কত দুরের অথচ ঔপন্যাসিকের রচনা গুনে এরা আমাদের কত নিকটতম বলে মনে হয়। যে কল্পনা জগতকে বঙ্কিচন্দ্র তার রচনা কৌশলে বাস্তব করে তুলেছেন। আর এই সব বাস্তব কল্পনা রোমান্সকে নিয়ে গেছে উচ্চ শিখরে।

বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গুলি স্থল: দুই ভাগে বিভক্ত এক শ্রেণী সম্পূর্ন বাস্তব, সামাজিক ও পরিবারিক জীবনের বর্ণনা ও ব্যাখাই তাহাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় শ্রেণী ঐতিহাসিক বা অসাধারণ ঘটনাবলীর উপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ হড়াবষ ও ৎড়সধহপব’ বলিয়া যে দুইটি প্রধান বিভাগ আছে, বঙ্কিমের উপন্যাসও সেই দুইটি বিভাগ বর্তমান। এখন হড়াবষ ও ৎড়সধহপব’ এর মধ্যে যে মৌলিক প্রভেদটুকু আছে, তাহা আমা দিগকে স্পষ্ঠ করিয়া বুঝিতে হবে। প্রধানত: উহাদের মধ্যে যে প্রভেদ তাহা বাস্তব গুনের আপেক্ষিক প্রাধান্য লইয়া । ঘড়াবষ অবিমিশ্রভাবেই বাস্তব, ইহার মধ্যে কল্পনার ইন্দ্রধনুরাগ সমাবেশের অবসর অত্যন্ত অল্প। জড়সধহপব- এর বাস্তবতা অপেক্ষাকৃত মিশ্র ধরনের ; ইহা জীবনের সহজ প্রবাহ অপেক্ষা তাহার অসাধারণ উচ্ছাস বা গৌরবময় মূহুর্তগুলোর উপর অধিক নির্ভর করে। অন্তরে বিরচিত বিকাশগুলি, মনের উঁচু সুরে বাঁধা ঝংকার গুলি, জীবনের বর্ণবহুল শোভাযাত্রা সমারহ ইহাই মুখ্যত: রোমান্সের বিষয়বস্তু।

রোমান্স লেখককের বাস্তব ও ঐতিহাসিক ভিত্তির উপর সৌধ নির্মান করিতে হয় মনস্তত্ব বিশ্লেষনের দ্বারা কার্য-কারণ সম্পর্ক স্পষ্ঠ করিতে হয়, ইহার বাতাসে যে বিচিত্র বর্ণের ফুল ফুটে, তাহাকে মৃত্তিকার সহিত সম্পর্কানিত্ব করিয়া দেখাইতে হয়। তবে সামাজিক উপন্যাসের সঙ্গে ইহার একমাত্র প্রভেদ যে, বাস্তবতার বন্ধন ইহাকে একেবারে নাগ পাশের মতো সুদৃঢ় ভাবে জরাইয়া ধরে নাই, ইহার মধ্যে বিচিত্র অসাধারণ ব্যাপারের অপেক্ষাকৃত অধিক অবসর আছে। সাধারণ উপন্যাসের ন্যায় রোমান্সের ক্ষেত্রে বাস্তবতার দাবি এত প্রবল বা সর্বগ্রামী নহে। বঙ্কিমচন্দ্রের রোমান্স গুলি আলোচনার সময়ে সামাজিক উপন্যাসের সহিত রোমান্সের এই মৌলিক প্রভেদটি আমাদের মনে রাখিতে হইবে। প্রত্যেক জাতির একটি বিশেষ রকম রোমান্সের দিক প্রবনতা আছে, এবং এই রোমান্সের প্রকৃতি তার বাস্তব জীবনের বিশেষত্বও উপর নির্ভর করে ইউরোপীয় রোমান্স আমাদের বাঙালী জীবনের আবেষ্ঠনের মধ্যে ঠিক মিলবে না; আমাদের জাতীগত ও প্রকৃতিগত বৈশিষ্টের উপর আমাদের রোমান্সের প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। এই মানদণ্ড বিচার করিতে গেলে কপালকুন্ডলার রোমান্স আমাদের বাস্তব জীবনের অবস্থা সহিত সুসঙ্গত হইয়াছে।

‘রোমন্স’ শব্দের অভিধানিক অর্থ অত্যাশ্চর্য ঘটনাপূর্বক গল্প কাহিনী। অর্থাৎ গল্প বলার সময় ঘটনা বলার মধ্যে চিত্তাকর্ষক অথচ অবাস্তব বিবরণ পেশ করা। রোমান্স মূলক কাহিনীর বড় বৈশিষ্ট কাহিনীর বড় রোমান্সের মধ্যে অতিপ্রাকৃত উপাদান থাকবে পৌড়বাড়ি আলো আাঁধারী পরিবেশ, দুঃসাহসিক ও অতিকল্পনা থাকবে ঘটনাস্থল অনেক দুরে থাকবে সাধারণত যেখানে নির্জনতা রয়েছে। রোমান্সের নায়ক হবে দুঃসাহসিক ও অমিয় শক্তির অধিকারী। বঙ্কিমচন্দ্র প্রধানত ছয়টি আধার থেকে রোমান্সের উপকরন সংগ্রহ করেছেন সেই ছয়টি উৎস হলো (১) ইতিহাস, (২) দেবশক্তি বা অতিপ্রাকৃতিক উপাদান,(৩) রহস্যময় দৃঢ় ব্যাক্তিত্বশালী মনষ্য চরিত্র, (৪) কল্পনা, (৫) রহস্যময় বা রহস্যময় ঘটনা, (৬) প্রাচীন ভগ্নœ প্রাসাদ।

কপালকুন্ডলা উপন্যাসে রোমান্সের উপাদান গুলোর মধ্যে অপ্রাকৃতিক উপাদান অন্যতম। এই উপাদান গুলোর মধ্যে আমরা দেখতে পাই জ্যোতিষের ভবিষ্যদ্বানী, চিঠি, যোগশক্তি স্বপ্ন, নাটকিয়তা, কৌতূহল সংলাপ, সন্ন্যাসী মহাপুরুষ, রাত্রিকালীন ঘটনার সংগঠন, অতিলৌকিক সংকেত অভিমান, গান ছড়া ইত্যাদি।

ঔপন্যাসিক স্বপ্নকে ব্যবহার করে কপালকুন্ডলা নিশ্চিত পরিনামের দিক নির্দেশ করেছেন। স্বপ্নই কপালকুন্ডলাকে আত্মবলিধানে উদ্ধুদ্ধ করেছিলো। চিঠির মাধ্যমে ঔপন্যাসিক নবকুমার এর মনে কপালকুন্ডলার সম্পর্কে সন্দেহের বীজ সৃষ্টি করেছিলেন সৃষ্টি করেছিলেন যা উপন্যাসের পরিনতিকে তরান্বিত করেছে এবং এই উপন্যাসে রোমান্সকে নিয়ে গেছে উচ্চতর শিখরে।

রোমন্সের আর একটি উপাদানের নাম ইতিহাস। কপালকুন্ডলা উপন্যাসের মধ্যে আমরা বাদশাহ জাহাঙ্গীর, শাহ মেহের উন্নিসা, সেলিম ইত্যাদি ইতিহাস থেকে গ্রহণ করেছেন যা রোমান্সকে করেছে শিল্পসম্মত। এবং সঙ্গতিপূর্ন। কপালকুন্ডলা এবং মতিবিবির রূপের বর্ণনায় রোমান্সের অবাহ সৃষ্টি করেছেন এই উপন্যাসে নবকুমার ও কপালকুন্ডলা ও মতিবিবির মধ্যে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তার মূলে রয়েছে রূপজমোহ নবকুমারের রূপজমোহ দ্বিমাত্রিক। যা রোমান্সের ভাব সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

কপালকুন্ডলা উপন্যাসের মধ্যে আরেকটি উক্তি রোমান্সের অবেশ সৃষ্টি করেছে’ এই উপন্যাসের প্রথম খন্ডের প্রথম পরিচ্ছেদ ‘সমুদ্রতটে’ বলেছে নবকুমারের প্রতি ভালোবাসা হোক বা তাকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যেই হোক নবকুমার আকস্মাৎ বনের মধ্যে দূর্গম পরিবেশে দেবমূর্তি দেখে বাকশুণ্য হলেন। রমনী ও সেই মূহুর্তে স্পন্দনহীন। বিশাল দুটি চোখ নবকুমারের মুখের উপর স্থীর হয়ে রইল, কিছুক্ষন পরে কপালকুন্ডলা বললেন ‘‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ’’ তার এই উক্তিটি রোমান্সকে নিয়ে গেছে উচ্চ শিখরের।

রোমান্স ধর্মী উপন্যাস গুলোর মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের কপালকুন্ডলা অন্যতম। দূর্গেশনন্দিনী যে রোমান্স ঐতিহাসিক, যুদ্ধ বিগ্রহ ও সাহিত্য সুলভ প্রেমের আশ্রয়কে ধীরে ধীরে দানা বেধে উঠেছিলো তা কপালকুন্ডলাতে নেই। কপালকুন্ডলাতে একেবারে সমস্ত বাইরের বিষয় ত্যাগ করে নিজের অন্তনির্হিত রসের দ্বারায় পূর্ন বিকশিত হয়ে উঠেছে। দুর্গেশনন্দিনীতে গতানুগতির যে একটি জরতা ছিল তা কপালকুন্ডলাতে কল্পনা শক্তির অসামান্য সাহসীকতার সচেতন লীলা চঞ্চল হয়ে উঠেছিলো। অরন্যবাসিনী কপালকুন্ডলা চির সন্নাসী কাপালিক ও নবকুমারের মূর্তি কল্পনার মধ্যে দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র রোমান্সকে করেছে শিল্পসম্মত যা বঙ্কিমচন্দ্রের দক্ষতা।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের রোমান্স ধর্মী উপন্যাসের অন্যতম উৎস দেবশক্তির লীলা। এর প্রথম সার্থক অভিব্যক্তি পাওয়া যায় কপালকুন্ডলায়। কপালকুন্ডলা প্রকৃতি পালিতা। কাপালী কালিকা ভক্তি তার চরিত্রে গভীর ছাপ আছে। তান্ত্রিক ধর্ম সাধনা, কালিকানুরাগ ও আরন্যভাগ কপালকুন্ডলা চরিত্রে যে রহস্যময়তা জটিল অসাধারন মানসিকতার জন্ম দিয়েছে তার মধ্যে রোমান্স প্রকৃত রস। তাই নবকুমারের সীমাহিন প্রণয়ে বিতৃষ্ণা ব্যাবহারিক জীবনে লোভহীনতা, সন্ন্যাসীনি মনোভাব সর্বপরী কালিকার নির্দেশ আত্ববির্সজন। সাগরতীর বাসিনী কাপালিকা ু প্রতিপালিত চির সন্ন্যাসিনী কপালকুন্ডলার মূর্তি কল্পনায় বঙ্কিম যে অসামান্য প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন তা একজন বাঙালী ঔপন্যাসিকের বাস্তবিকই বিষ্মযকর। আর এই বিষ্মযকর কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন বঙ্কিম।

আছে ইতিহাস আর ইতিহাসের চরিত্র। তার সাথে যোগ হয়েছে বাস্তব জীবনের ঘটনা ও রহস্যময় জীবনের নানা দৃশ্য। গ্রীক ট্রাজেডীর মতো সামান্য বর্নণায় পরিনতি বলে দিলেন কল্পনা শক্তি ছিলো বলেই বাস্তব ইতিহাস রহস্যময় পরিবেশ শিল্পমান লাভ করেছে। যার পরিনতি রোমান্সের সার্থক উদাহরণ।

বঙ্কিমচন্দ্রের চন্দ্রের উপন্যাস সমূহ রোমান্টিক ধর্মী। তিনি রোমান্সকে সম্প্রসারিত করেছেন ইতিহাস বৃত্তে এবং সমাজ বৃত্তে। তিনি মূলত রোমান্টিক। আর রোমান্টিক মনোবৃত্তই সৌন্দর্য্য অন্বেষন। তিনি সৌন্দর্য্য রীতিকে সম্প্রসারন করেছেন নায়িকাদের রূপ বর্ননায় পোশাক পরিচ্ছেদ, দৈনিন্দন জীবনে। বিশেষ করে রোমান্সের নায়িকাদের সৌন্দর্য দ্বারা কাহিনীর গতিকে এবং মানব চরিত্রকে উদঘাটন করেছেন। বঙ্কিমের প্রতিটি উপন্যাসে নারীর রূপ ও মানব মনের জটিল জীবন চিত্র প্রতিবিম্বিত।

কপালকুন্ডলা উপন্যাসের রোমান্টিকতা প্রকৃতির মধ্য দিয়ে দুরগামী সৌন্দর্যে স্থিত। কপালকুন্ডলার ভাব জগত মুক্ত স্বাধীন কল্পনা বিশিষ্ট। উপন্যাসের কাহিনীতে সৃষ্ঠ মিলন বিরহ, দ্বন্দ সংঘাত, আচার আচরন তান্ত্রিক সাধনা সবই প্রকৃতি নির্ভর। উপন্যাসের পরিবেশ, পটভূমি, চরিত্র, মনস্তাত্বিক সবই রোমান্টিক ঘেরা। কপালকুন্ডলা উপন্যাসে অলৌকিকতা ও অতিপ্রাকৃত আবহ এসেছে রোমান্টিকতার বাহন হিসেবে। নবকুমারের সাথে বিবাহ জালে ভবিষ্যৎ শুভ জানার জন্য দেবী পদে বিল্বপর্ত্রাপণ কেবল একটি পূজার বাহ্য অনুষ্ঠান মাত্র নয় তা কপালকুন্ডলার ভক্তি প্রবন হৃদয়ে একটি অঙ্গাত আশঙ্কার ছায়া ফেলে তার নতুন জীবনের প্রতি অনাশক্তি বাড়িয়ে তুলেছে ও ভবিষ্যৎ বিপৎপাতের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করনে সাহায্য করেছে। কাপালিক যে স্বপ্ন দেখেছে – দেবী পদে কপালকুন্ডলার বলি, কপালকুন্ডলাও একই স্বপ্ন দেখেছে এবং পরিনতিতে স্বপ্ন বাস্তব করার যে প্রয়াস এসবই রোমান্টিকতার বিশেষ উপকরণ। কপালকুন্ডলার পরিনতির মধ্যে রোমান্টিকতার বিশেষ দিক উন্মোচিত। কপালকুন্ডলার পরিনতির জন্য তার আশৈশব অরন্যপ্রীতি কাপালিকের ধর্ম বিশ্বাস, মতিবিবির ঈর্ষা নবকুমারের রূপ ইষ্ণা প্রভৃতি কারণ থাকলেও মূলত নিয়তি বাদই এখানে পরিনতিকে অনিবার্য করে তুলেছে। শিল্প ভারতীয় গ্রীক সাহিত্য হতে নিয়তিবাদকে এনে তার উপন্যাসে গ্রথিত করেছেন। তাতে উপন্যাসটি রোমান্সধর্মী রস সূজনে সফল হয়েছে।
কপালকুন্ডলা উপন্যাসে বিশ্ব প্রকৃতি রূপ নিয়েছে । কি বন কি সমুদ্র, কি আকাশমন্ডল সবই বঙ্কিমের মানস চেতনায় এসেছে কপালকুন্ডলা উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্র কপালকুন্ডলা আচরিত জীবনসত্যেও সারথি হয়ে। বিজন সমুদ্র তীরের অতুলনীয় মহিমা এ উপন্যাসে রোমান্টিক অনুভূতির পরশ বুলিয়ে দিয়েছে উপন্যাসে নবকুমার কপালিক মতিবিবি কপাল কুন্ডলা সবার উপরে রোমান্সের প্রভাব পড়েছে। মানব মনের গহন গভীরে নেমে তার রহস্যের সন্ধান করা হয়েছে। অরন্য বাসীকে সংসারে এনে মানব রহস্যের বৈচিত্র্য অনুসন্ধান করা হয়েছে। অতীতের বিচিত্র বেশ ভূষা ও আচার ব্যবহার অতীতের আকাশ-বাতাসে লঘু খন্ডের মত যে সমস্ত অতি প্রকৃতি বিশ্বাস ও কাবিত্বময় কল্পনা ভাসিয়া বেড়ায়, রোমান্স লেখক সেইগুলোকে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেন। অবশ্য এই সমস্ত অসাধারণত্বের মধ্যেও রোমান্স বাস্তব জীবনের সহিত একটি নিগূঢ় ঐক্য হারায় না, জীবনের সহিত যোগসূত্র হারাইলেই ইহা একটি সম্পূর্ণ অম্ভব পরীর গল্পের মত এইরূপ সম্পূর্ণ বাস্তব সম্পক শূন্য ছিল বলিয়া তার উপন্যাস শ্রেণী মধ্যে পরিগণিত হইবার স্পর্ধা ছিল না। তাহার অন্তহীন মায়া ঘণ অরণ্যানীর মধ্যে আমাদের বাস্তব জীবনের যুগের যে প্রবর্ধমান বাস্তব প্রবণতার মধ্যে সামাজিক উপন্যাস জন্ম গ্রহণ করিয়াছে তাহা রোমান্সের উপরও নিজ প্রভাব বিস্তার করিতে ছাড়ে নাই। আধুনিক রোমান্স ও বাস্তবতার মন্ত্রে অনুপ্রাণিত হইয়া সত্যের কাঠোর সংযম স্বীকার করিয়া লইয়াছে। রোমান্সের জগতেও আর অতিপ্রাকৃত বা অবিশ্বাস্যের কোন স্থান নাই। রোমান্সের যাহা কিছু আতিশয্য ও অসংগতি তাহা চরিত্রের উপর দিয়াই ব্যয়িত হইয়াছে।

কপালকুন্ডলা উপন্যাসের কাহিনী দৈব দ্বারা গলিত হয়েছে। কপালকুন্ডলা উপন্যাসে কাপালিক ও কপালকুন্ডলার স্বপ্ন দেখা আকাশ পানে অপ্রাকৃত দৃশ্য ও অশরীরী বানী শ্রবণ দেবতার পদপ্রাপ্ত হতে বিল্বপত্রের পতন ইত্যাদি ব্যাপারগুলোই কাহিনীকে চালিতে করে পরিনাম মুখিতার দিক নিয়ে গেছে। কপালকুন্ডলা জীবনের প্রতি অনাসক্তি ও উদাসীন্যের মূলে এই অতিপ্রাকৃত ঘটনাগুলোর ভূমিকাই প্রধান। কপালকুন্ডলা নবকুমার এবং মতিবিবি বঙ্কিমের কল্পনা প্রবণ মস্তিস্কের সৃষ্টি। তিনি রোমান্স সৃষ্টিতে বিজন বন, নির্জন সমুদ্র উপকুল প্রভৃতি পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন কল্পনার সাহায্যে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কপালকুন্ডলা। সমাজের বাইরে লোকালয়ের বাইরে নির্জন বালুতটে এক ভয়ঙ্কর কাপালিকের আশ্রয়ে প্রতিপালিত এক অপরিচিত আলো আঁধারিতে ভাগ্যবিড়নিত নারীর স্বল্পায়ু জীবনের করুন কাহিনীর কল্পনায় বঙ্কিমচন্দ্র সফল হয়েছেন।

কপালকুণ্ডলা উপন্যাসে রোমান্সের আতিশয্য প্রবল। প্রথম উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনীতে লেখকের যে প্রতিভার সম্ভবনা দেখা গিয়েছিল সেই প্রতিভা পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে কপালকুন্ডলা উপন্যাসে। দূর্গেশনন্দিনী প্রথম উপন্যাস হওয়ার কারণে নানা দ্বিধা সংশয় ছিল। কিছুটা ইতিহাস এবং অধিকাংশ কল্পনার উপর আশ্রয় করায় কাহিনী বিন্যাসে চরিত্রায়নে জটিলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি কিন্তু কপালকুন্ডলা উপন্যাসের ইতিহাস এবং কল্পনার সুষম মিশ্রন ঘটায় উপন্যাসটি শ্রেষ্ট রোমান্সধর্মী একটি উপন্যাসের পরিণত হয়েছে। রোমান্স জাতীয় উপন্যাসের অতি লৌকিক ঘটনায় সমন্বয় ঘটবে। কপালকুন্ডলা উপন্যাসেও অনেক অতি লৌকিক ঘটনার সমন্বয় ঘটেছে। কপালকুন্ডলা উপন্যাসের মোট ৩১টি অনুচ্ছেদের মধ্যে ১২টি অনুচ্ছেদই রাত্রিকালীন ঘটনা উল্লেখ করা হয়ে। রহস্যময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে কাহিনী সংঘটনে রাত্রিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। নবকুমারের সাথে কপালকুন্ডলার বিয়ে অত;পর পলায়পদে মতিবিবির সাথে দেখা; ব্রাক্ষণ বেশধারীর সাথে দেখা কাপালিকের সাথে দেখা। রোমান্স সৃষ্টির আরও একটি বড় উপদান রহস্যময় পত্র কপালকুন্ডলা উপন্যাসে ব্রাক্ষণ বেশির সংক্ষিপ্ত রহস্যময় চিঠি নবকুমারের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে। আর এখান থেকে নবকুমার অন্তদ্বন্দ্বে ভুগতে তাকে। কপালকুন্ডলা উপন্যাসে রোমান্সের লক্ষণ প্রবল। মানব প্রকৃতির নিগূত রহস্য নিয়তি ও মানব ভাগ্যের নিদারুন পরিনাম বঙ্কিমচন্দ্র গীতির স্বেচ্ছায়। সূশ্মম
নিস্তারিক দ্বন্দ্ব ও নাটক চমৎকারেত্বের দ্বারা বর্ণনা করেছেন।

কপালকুন্ডলা উপন্যাসের রচনা বঙ্কিমচন্দ্রের গভীর মনন ঔতিহাসিক অনুসন্ধিৎসা, মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণী দৃষ্টি ভঙ্গি ও প্রকৃতির .. অপূর্ব সমঞ্চয় ঘটেছে- যা একটি সার্থক রোমান্সধর্মী উপন্যাস লিখতে প্রয়োজন। সবদিকে বিবেচনা বলা চলে রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসাবে কপালকুন্ডলা সার্থকতার দাবীদার।

সার-সংক্ষেপ

পরিশেষে বলা যায় যে, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের একটি বিশেষ রকম রোমান্সের দিক প্রবনতা আছে, এবং এই রোমান্সের প্রকৃতি তার বাস্তব জীবনের বিশেষত্বও উপর নির্ভর করে ইউরোপীয় রোমান্স আমাদের বাঙালী জীবনের আবেষ্ঠনের মধ্যে ঠিক মিলবে না; আমাদের জাতীগত ও প্রকৃতিগত বৈশিষ্টের উপর আমাদের রোমান্সের প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। এই মানদণ্ড বিচার করিতে গেলে কপালকুন্ডলার রোমান্স আমাদের বাস্তব জীবনের অবস্থা সহিত সুসঙ্গত হইয়াছে।

কপালকুন্ডলা উপন্যাসে রোমান্সের উপাদান গুলোর মধ্যে অপ্রাকৃতিক উপাদান অন্যতম। এই উপাদান গুলোর মধ্যে আমরা দেখতে পাই জ্যোতিষের ভবিষ্যদ্বানী, চিঠি, যোগশক্তি স্বপ্ন, নাটকিয়তা, কৌতুহল সংলাপ, সন্ন্যাসী মহাপুরুষ, রাত্রিকালীন ঘটনার সংগঠন, অতিলৌকিক সংকেত অভিমান, গান ছড়া ইত্যাদি।

ঔপন্যাসিক স্বপ্নকে ব্যবহার করে কপালকুন্ডুলা নিশ্চিত পরিনামের দিক নির্দেশ করেছেন। স্বপ্নই কপালকুন্ডলাকে আত্ববলিকানে উদ্ধুদ্ধ করেছিলো। চিঠির মাধ্যমে ঔপন্যাসিক নবকুমার এর মনে কপালকুন্ডলার সম্পর্কে সন্দেহের বীজ সৃষ্টি করেছিলেন সৃষ্টি করেছিলেন যা উপন্যাসের পরিনতিকে তরান্বিত করেছে এবং এই উপন্যাসে রোমান্সকে নিয়ে গেছে উচ্চতর শিখরে।

রোমন্সের আর একটি উপাদানের নাম ইতিহাস। কপালকুন্ডুলা উপন্যাসের মধ্যে আমরা বাদশাহ জাহাঙ্গীর, মেহেরুন্নিসা, সেলিম ইত্যাদি ইতিহাস থেকে গ্রহণ করেছেন যা রোমান্সকে করেছে শিল্পসম্মত। এবং সঙ্গতিপূর্ন। কপালকুন্ডলা এবং মতিবিবির রূপের বর্ননায় রোমান্সের অবাহ সৃষ্টি করেছেন এই উপন্যাসে নবকুমার ও কপালকুন্ডলা ও মতিবিবির মধ্যে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তার মূলে রয়েছে রূপজমোহ নবকুমারের রূপজমোহের দ্বিমাত্রিক। যা রোমান্সের ভাব সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

কপালকুন্ডলা উপন্যাসের মধ্যে আরেকটি উক্তি রোমান্সের অবেশ সৃষ্টি করেছে’ এই উপন্যাসের প্রথম খন্ডের প্রথম পরিচ্ছেদ ‘সমুদ্রতটে’ বলেছে নবকুমারের প্রতি ভালোবাসা হোক বা তাকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যেই হোক নবকুমার আকস্মাৎ বনের মধ্যে দূর্গম পরিবেশে দেবমূর্তি দেখে বাকশুণ্য হলেন। রমনী ও সেই মূহুর্তে স্পন্দনহীন। বিশাল দুটি চোখ নবকুমারের মুখের উপর স্থির হয়ে রইল, কিছুক্ষন পরে কপালকুন্ডলা বললেন ‘‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ’’ তার এই উক্তিটি রোমান্সকে নিয়ে গেছে উচ্চ শিখরের।

সহায়ক গ্রন্থ

১. বঙ্কিমচন্দ্রজীবনী, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য,ড
২. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (জীবনকথা)
৩. বঙ্কিম রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত
৪. বঙ্কিমচন্দের জীবন সাহিত্যকৃতি, মোবাশ্বের আলী
৫. বাংলা গদ্যের বিশেষ যুগ, সম্পাদনা প্রবণ চৌধুরী
৬. বাংলা উপন্যাসের ধারা, অচ্যুত গোস্বামী
৭. বঙ্কিম মানস, অরবিন্দ পোদ্ধার
৮. বঙ্কিম বরণ: মোহিতলাল মজুমদার
৯. বঙ্গ সাহিত্য উপন্যাসের ধারা, শ্রী কুমার বন্দোপাধ্যায়
১০. বঙ্কিমচন্দ্র: সার্ধশত জন্মবর্ষে— আবুল কাসেম ও ফজলুল হক

Post Views: 5

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Recent Posts

  • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের  ছোটগল্পে আঙ্গিকে ফ্রয়েডীয় চিন্তার স্বরূপ
  • টার্ম পেপার-3 রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবে কপালক্ণ্ডুলার সার্থকতা আলোচনা কর’
  • ত্রিশোত্তর কালের কবি জীবনানন্দ দাশের কাব্য প্রতিভার স্বরপ বিশ্লেষণ। টার্ম পেপার-2
  • গেছে দেশ দুঃখ নাই, আবার তোরা মানুষ হ!
  • কাজী নজরুল ইসলামের প্রবন্ধ রাজবন্দীর জবানবন্দী

Most Viewed Posts

  • রোমান্টিক উপন্যাস হিসেবে কপালকুণ্ডলা এর সার্থকতা আলোচনা কর । 211003 (475)
  • কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের অবলম্বনে নবকুমার চরিত্রটি আলোচনা কর। 241003 (386)
  • SSC Result 2022 with Marksheet – All Education Boards (377)
  • জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স শেষ পর্বের সিলেবাস-2022 (353)
  • চর্যাপদ এর সমাজচিত্র আলোচনা কর। 231001 (351)
  • আলাওলের পদ্মাবতী কাব্য অবলম্বনে সিংহল দ্বীপের বর্ণনা দাও। 221003 (340)
  • বিসর্জন নাটকের জয়সিংহ চরিত্রটি বিশ্লেষণ কর। 22100 (326)
  • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এর ডাইনি গল্পের বিষয়বস্তু আলোচনা কর।Nu Bangla 231005 (319)
  • উপভাষার শ্রেণিবিভাগ ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো। (308)
  • কাহিনিকাব্য হিসেবে নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যের সার্থকতা আলোচনা কর। (305)

Archives

  • December 2025 (3)
  • November 2025 (1)
  • September 2025 (6)
  • May 2025 (2)
  • March 2025 (1)
  • November 2022 (1)
  • September 2022 (2)
  • June 2022 (5)
  • March 2022 (1)
  • February 2022 (10)
  • January 2022 (40)
  • December 2021 (86)

Categories

  • Uncategorized
  • অনান্য
  • অনার্স ১ম বর্ষ
  • অনার্স ২য় বর্ষ
  • অনার্স ৩য় বর্ষ
  • অনার্স ৪র্থ বর্ষ
  • অনুবাদে চিরায়িত সাহিত্য
  • এমফিল/পিএইচডি
  • চাকরির প্রস্তুতি
  • টামপেপার
  • ট্রামপেপার
  • ধ্বনিবিজ্ঞান ও ভাষাতত্ত্ব
  • পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যের সমালোচনা পদ্ধতি
  • পিএইডি
  • প্রশ্ন ব্যাংক
  • প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিতা
  • বাংলা উপন্যাস
  • বাংলা উপন্যাস-১
  • বাংলা উপন্যাস-২
  • বাংলা উপন্যাস-৩
  • বাংলা কবিতা
  • বাংলা কবিতা-১
  • বাংলা কবিতা-২
  • বাংলা ছোটগল্প
  • বাংলা ছোটগল্প-১
  • বাংলা ছোটগল্প-২
  • বাংলা নাটক
  • বাংলা নাটক-১
  • বাংলা প্রবন্ধ
  • বাংলা প্রবন্ধ-১
  • বাংলা ভাষার ইতিহাস ও ব্যবহারিক বাংলা
  • বাংলা রম্য ও ভ্রমণ সাহিত্য
  • বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-১
  • বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-২
  • বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-৩
  • বাংলাদেশ, বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতি
  • বাংলাদেশের সাহিত্য
  • ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য
  • মধ্য যুগের কবিতা
  • মাস্টার্স
  • রূপতত্ত্ব, রসতত্ত্ব, ছন্দ, অলংকার
  • সাজেশন্স
  • সিলেবাস
  • স্বাধীন বাংলার অভূদয়ের ইতিহাস
© 2025 Nu Bangla | Powered by Superbs Personal Blog theme