বাংলা বিভাগ
এম.এ শেষ বর্ষ
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা
টার্ম পেপার : ২০১৬
টার্ম পেপার
শিরোনাম : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্পে আঙ্গিকে ফ্রয়েডীয় চিন্তার স্বরূপ’
উপস্থাপনায়
আলমগীর হোসেন
বাংলা বিভাগ, এম.এ শেষ বর্ষ
রোল নম্বর : ১৩০৪০
শিক্ষাবর্ষ: ২০১৩-১৪
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা
তত্ত্বাবধায়ক
ড. মো. আবদুল মজিদ
সহযোগী অধ্যাপক
বাংলা বিভাগ
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা
মুখবন্ধ
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ত্রিশোত্তর বাংলা কথাসাহিত্যের একজন শক্তিমান লেখক। তাঁর সাহিত্য জীবনাকর্ষি, মৃত্তিকা ঘনিষ্ঠ এবং মানবমনের রহস্য সন্ধানী। নিপীড়িত মানুসের প্রতি বিশ্বস্ততার কারণে চলমান সমাজের ভাঙাচোরা মানুষগুলোকে কুড়িয়ে একটা শোষন হীন নতুন সমাজ গড়ার প্রয়াস তাঁর সাহিত্যে পরিলক্ষিত হয়। বাংলা কথাসাহিত্যের ধারাকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু যে স্ফীততর বা অগ্রগামী করেছেন তাই নয়, সেখানে তিনি এনেছেন অচেনা আন্দোলন, সৃষ্টি করেছেন অস্থির ঘূর্ণি।
প্রথম পর্বে মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড, ইয়ুং, অ্যাডলার প্রমুখ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি মার্কসবাদে দীক্ষা নেন। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কমিউনিস্ট পাট্রির সক্রিয় সদস্য হন এবং আমৃত্যু এই দলের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। সাহিত্যের মাধ্যমে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের বিশ্লেষণ এবং মানুষের মনোরহস্যের জটিলতা উন্মোচনে তিনি ছিলেন একজন দক্ষশিল্পী।
তাই তাঁর ফ্রয়েডীয় চিন্তা বিষয়টি বাংলা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট গবেষণা হওয়ার দাবি রাখে । এর অংশ হিসেবে এম.এ শেষ বর্ষের পাঠ্যসূচির অর্š—ভূক্ত টার্ম পেপার প্রস্তুত কর্মটি একটি ক্ষুদ্র গবেষণা হলেও বাংলা বিভাগের প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে চিহ্নিত। টার্ম পেপার গবেষণার জন্য আমার নির্ধারিত বিষয় হলো ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফ্রয়েডীয় চিন্তা স্বরূপ’ এই গবেষণা কর্মটি ধারাবাহিকতা বা যথার্থতার প্রশ্নে কতটা উত্তৃর্ণ হয়েছে বা হয়নি তার চেয়ে বড় কথা গবেষণা মাধ্যমে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফ্রয়েডীয় চিন্তা স্বরূপ খুঁজে পেয়েছি। তবুও সকল দিক বিবেচনা করলে গবেষণা কর্মটি যথাযোগ্য মূল্যায়ন হবে বলে আমার বিশ্বাস।
আলমগীর হোসেন
বাংলা বিভাগ, এম.এ শেষ বর্ষ
রোল নম্বর : ১৩০৪০
শিক্ষাবর্ষ: ২০১৩-১৪
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা
অনুমোদনপত্র
আলমগীর হোসেন কর্তৃক ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফ্রয়েডীয় চিন্তা স্বরূপ’ শীর্ষক গবেষণাপত্রটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ শেষ বর্ষের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পাঠ্যক্রমের সম্পূরক হিসেবে অনুমোদন করা হল ।
তত্ত্বাবধায়ক
ড. মো. আবদুল মজিদ
সহযোগী অধ্যাপক
বাংলা বিভাগ
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা
সূচিপত্র
শিরোনাম পৃষ্ঠা
১. ভূমিকা ০৮
২. পরিচয় ১০
৩. শিক্ষাজীবন ১১
৪. সামাজিক জীবন ১২
৫.রাজনৈতিক ভাবনা ১৪
৬. অর্থনৈতিক ভাবনা ১৬
৭. কবিতা ১৮
৮. ছোটগল্প ১৯
৯. উপন্যাস ২০
১০. প্রবন্ধ ও পত্রসাহিত্য ২১
১১. নাট্যসাহিত্য ২২
১২. সংগীত ও নৃত্যকলা ২৪
১৩. চিত্রকলা ২৫
১৪. রাজনৈতিক মতাদর্শ ও শিক্ষাচিন্তা ২৬
১৫. বাঙালি সংস্কৃতিতে রবীন্দ্র প্রভাব ২৮
১৬. সার-সংক্ষেপ ২৯
১৭. সহায়ক গ্রন্থ ৩১
ভূমিকা
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ত্রিশোত্তর বাংলা কথাসাহিত্যের একজন শক্তিমান লেখক। তাঁর সাহিত্য জীবনাকর্ষি, মৃত্তিকা ঘনিষ্ঠ এবং মানবমনের রহস্য সন্ধানী। নিপীড়িত মানুসের প্রতি বিশ্বস্ততার কারণে চলমান সমাজের ভাঙাচোরা মানুষগুলোকে কুড়িয়ে একটা শোষন হীন নতুন সমাজ গড়ার প্রয়াস তাঁর সাহিত্যে পরিলক্ষিত হয়। বাংলা কথাসাহিত্যের ধারাকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু যে স্ফীততর বা অগ্রগামী করেছেন তাই নয়, সেখানে তিনি এনেছেন অচেনা আন্দোলন, সৃষ্টি করেছেন অস্থির ঘূর্ণি। পাড় ভেঙেছে, তাল কেটেছে, দ্বীপ জাগিয়েছেন, ঢেলেছেন প্রচুর লোনাজল। মধ্যবিত্ত জীবনের কৃত্রিমতা, ন্যাকামি ও ভণ্ডামি ত্যাগ করে করে তিনি জেলে, চাষি, মজুর, শ্রমিক মানুষকে ভালবেসেছেন মনের মাধুরী দিয়ে নয়, বরং মনের জ্বালা দিয়ে। গ্রামীন জীবনের দৃশ্য চিত্র এবং আন্তরচিত্র নির্মানের অভিনবত্বে যে প্রাগ্রসর চেতনার স্বাক্ষর রেখেছেন তা বৈপ্লবিক গুণগ্রামে চিহ্নিত।
মানিক এখন হয়তো দূরতম প্রদীপ। জ্বলজ্বল নক্ষত্রকে কত আলোকবর্ষ দূর থেকে দেখলে তা মঙ্গলপ্রদীপের মতো সৌম্যরূপ ধারণ করে- তা অনুধাবন করা কষ্টকর নয়। বাংলাদেশী পাঠকসমাজ পাঠাভ্যাস ত্যাগ করেছে প্রায় সর্বাংশে, সাহিত্যপাঠকে নির্বাসন দিয়েছে আরো আগে; এখন কেবল তারাই পড়ে, যারা লেখে বা লেখার সাথে পরোভাবে সম্পর্কিত। যদিও সারা দুনিয়ায় এখনো ফিকশন রাইটাররা কিন্ডলের ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আমরা আমাদের নক্ষত্ররাজিকে ম্রিয়মাণ করে রাখছি, আপন অজ্ঞতার চশমা চোখে দিয়ে, স্মার্টলি।
কিন্তু কথাকার মানিক প্রবল,অবশ্যপাঠ্য। নাকি প্রাগৈতিহাসিক, পুতুল নাচের ইতিকথার মধ্যে লুকায়িত মানববিজ্ঞানের সূত্রগুলো আপন মতাবলেই বাঙালি পাঠককে পৃষ্ঠা-অরের জগতে ফিরিয়ে আনে বারবার। আমরা মানিককে স্মরণ করব- বাংলা কথাসাহিত্যের বিস্তৃত ভূগোলে অগ্রগামী গ্রষ্টা হিসেবেই। যারা মানিককে কেবল পদ্মানদীর মাঝি, পুতুল নাচের ইতিকথার মাধ্যমে পাঠ করতে চান, তাদের সাগর সেচে মুক্তো আনা এখনো বাকি আছে। ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’ বলে- এখনি মানিক কথাসাহিত্যে নিমজ্জন অনিবার্য। যারা চরিত্রাবিধানে পরাক্রমশালী হয়ে ঠাঁই নিয়ে থাকেন ক্যালেন্ডারের পাতা ধরে। এই ডাকাডাকির মধ্যে রয়েছে দায় মোচন অথবা কারুণ্য, কিঞ্চিত্ সম্মান প্রদর্শন। উপযোগবাদী এই সময়ে সাহিত্যকে আমরা আলস্য ও অবসরের বৈচিত্র্যসন্ধানী মনের বিপ্তি মিডিয়ায় পরিগণিত করেছি। মানিক তাঁদের মতো নন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মগজ দিয়ে পাঠকের মগজকে শাণিত করেছেন, ব্রেইনস্টর্ম তুলেছেন পাঠকের চিন্তাজগতে।
অচ্ছুত নিম্নবগেরু মানুষকে উপন্যাসের জমিনে সংস্থাপন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান কৃতিত্ব। নিম্নবর্গকে নিয়ে কাজ করেছেন অনেক ঔপন্যাসিক, সাধারণত বাংলা ঔপন্যাসিকরা এসেছেন উচ্চমধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত এলিট সমাজ থেকে। এদের মধ্যে কিছু জমিদার শ্রেণীভুক্ত, কিছু বা ব্রিটিশ শাসন কাঠামোভিত্তিক বৃত্তিতে নিযুক্ত। ‘উপন্যাস লেখকরা পরনিভরু এবং শাসকশ্রেণীর অংশীদার। এই মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ভুক্ত লেখকরা ইতিহাস, রোমান্স ও পরিচিত-পরিবেশ: এই তিন উৎস থেকে তাঁদের উপাদান সংগ্রহ করেন। তার বাইরের যে বিশাল নিরর দরিদ্র গ্রামীণ সমাজের কোটি কোটি মানুষ, তাঁরা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত লেখক ও পাঠকসমাজের কাছে অপরিচিত ও ধূসর অনামিকতায় আবৃত। এই বিশাল অপরিচিত জনসমাজের সুখ-দুঃখের অংশীদার হওয়া মধ্যবিত্ত লেখকের পক্ষেসুকঠিন। দারিদ্র্য আর মানবতার অপমান তাঁদের কাছে গল্প-উপন্যাসের রোমান্টিক উপাদান মাত্র’ । মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এই ধূসর অনামিকতায় আবৃত মানুষকে উপন্যাসপটে চিত্রিত করেছেন।
প্রারম্ভিক জীবন
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মে (১৩১৫ বঙ্গাব্দের ৬ জ্যৈষ্ঠ) বিহারের সাওতাল পরগনা,বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুমকা শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরে । জন্মপত্রিকায় তাঁর নাম রাখা হয়েছিল অধরচন্দ্র। তার পিতার দেওয়া নাম ছিল প্রবোধকুমার আর ডাকনাম মানিক। তাঁর পিতার নাম হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা নীরদাসুন্দরী দেবী। চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন অষ্টম পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তদনীন্তন ঢাকা জেলার সেটেলমেন্ট বিভাগের সাব-রেজিস্টার। পিতার বদলির চাকরির সূত্রে মানিকের শৈশব-কৈশোর ও ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয়েছে বাংলা-বিহার-ওড়িষার দুমকা, আরা, সাসারাম, কলকাতা, বারাসাত, বাঁকুড়া, তমলুক, কাঁথি, মহিষাদল, গুইগাদা, শালবনি, নন্দীগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল প্রভৃতি শহরে। তাঁর মা নীরদাসুন্দরীর আদিনিবাস ছিল পূর্ববঙ্গের গাউদিয়া গ্রামে। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে লেখক মৃগী রোগে আক্রান্ত ছিলেন যা পরবর্তী কালে জটিল অবস্থায় গমন করে। অবশেষে দীর্ঘদিন রোগভোগের পর ৩রা ডিসেম্বর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু ঘটে।
স্নাতক শ্রেণিতে অধ্যয়নের সময় বিচিত্রা পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প ‘অতসী মামী’ (১৯২৮) প্রকাশিত হলে পাঠক মহলে আলোড়নের সৃষ্টি হয়। পরে নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত লেখকের মর্যাদা লাভ করেন। বিশ শতকের তিরিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র ধারার বিরোধিতা করে যে কল্লোল গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে, সেই গোষ্ঠীর লেখক হিসেবে মানিকের স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে ওঠে।
সামাজিক জীবন
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে সুরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে কমলা দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তিনি বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এ সময় থেকে তাঁর লেখায় কম্যুনিজমের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
তিনি পূর্ববঙ্গ প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৪৬ সালে প্রগতি লেখক সংঘের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। দুবার তিনি এ সঙ্ঘের সম্মেলনে সভাপতিত্বও করেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তিনি কলকাতার টালিগঞ্জ অঞ্চলে ঐক্য ও মৈত্রী স্থাপনের প্রয়াসে সক্রিয় ছিলেন ভূমিকা রাখেন এবং ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ এপ্রিল প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ আয়োজিত জোসেফ স্টালিনের শোকসভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন।
কর্মজীবন
মানিক বন্দোপাধ্যায় কিছুদিন নবারুণ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে এবং পরবর্তী কালে বঙ্গশ্রী পত্রিকার সহসম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি একটি প্রেস ও প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন যা কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় ।১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে মানিক কয়েকমাস একটি সরকারি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
মানিক সাহিত্যের ধারা
পিতার বদলির চাকরির সূত্রে মানিকের শৈশব-কৈশোর ও ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয়েছে বাংলা-বিহার-ওড়িষার দুমকা, আরা, সাসারাম, কলকাতা, বারাসাত, বাঁকুড়া, তমলুক, কাঁথি, মহিষাদল, গুইগাদা, শালবনি, নন্দীগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল প্রভৃতি শহরে। তার মা নীরদাসুন্দরীর আদিনিবাস ছিল পূর্ববঙ্গের গাউদিয়া গ্রামে। এই গ্রামটির পটভূমি তিনি রচনা করেন তার প্রসিদ্ধ উপন্যাস পুতুলনাচের ইতিকথা। চাকরি সূত্রেই তার পিতা সাঁওতাল পরগনার দুমকায় গমন করেন। সেখানেই মানিকের জন্ম হয়েছিল । কিন্তু পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের কারণে ঐ সকল মানুষের জীবনচিত্র সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা ছিল মানিকের। তাই ঐ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবনচিত্রকে তাঁর সাহিত্যে অপূর্ব দতার সাথে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। বিচিত্র সব মানুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন লেখক। তার এই সকল অভিজ্ঞতাকেই তিনি তার সাহিত্যে তুলে ধরেছেন বিচিত্র সব চরিত্রের আড়ালে। পদ্মার তীরবর্তী জেলেপাড়ার পটভূমিতে রচনা করেন পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসটি।
জীবনের প্রথমভাগে তিনি ফ্রয়েডীয় মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এছড়া মার্কসবাদও তাঁকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। তাঁর অধিকাংশ রচনাতেই এই দুই মতবাদের নিবিঁড় প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ব্যক্তিগত ভাবে মানিক ছিলেন মধ্যবিত্ত মানসিকতার উত্তারাধিকারী। তাঁর প্রথম গল্পগুচ্ছ অতসী মামী ও অন্যান্য সংকলনে সব কয়টি গল্প এবং প্রথম উপন্যাস দিবারাত্তির কাব্য মধ্যবিত্ত জীবনভিত্তিক কাহিনী নিয়ে গড়া। এছাড়া গ্রামীণ হতদরিদ্র মানুষের জীবন চিত্রও তার বেশকিছু লেখায় দেখতে পাওয়া যায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে বস্তুবাদের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। মনুষ্যত্ব ও মানবতাবাদের জয়গানই তার সাহিত্যের মুল উপজীব্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের ভাঙ্গা গড়ার প্রত্য ও পরো প্রভাবকে তিনি তাঁর সাহিত্যে চিত্রায়িত করেছেন। সমাজের শাসক ও পুঁজিপতিদের হাতে দরিদ্র সমাজের শোষণবঞ্চনার স্বরূপ তুলে ধরেছেন সাহিত্যের নানান চরিত্রের আড়ালে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বমোট ৪০ টি উপন্যাস এবং ৩০০ টি ছোট গল্প রচনা করেছেন। তার লেখা অন্যতম ছোটগল্প হলো মাসি -পিসি।যেটি সর্বপ্রথম ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় ১৩৫২ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
কথাসাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যয়ের কৃতিত্ব চিহ্নিত করতে হলে পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। বাংলা উপন্যাসের সূচনালগ্নে বিশেষ করে সামাজিক নকশা এবং প্যারীচাঁদ মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের উপন্যাসে ‘নিম্নবর্গ’ কাহিনীর প্রয়োজনে ক্ষুদ্র অবস্থান লাভ করলেও, তাদের বিচ্ছিন্ন, দুর্বল ও সামঞ্জস্য বিধানের উপকরণ ছাড়া কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যায়নি। মানিকই পদ্মানদীর মাঝিতে কল্পনা ও সৃষ্টিশীলতার অসীম মতাবলে ‘নিম্নবর্গ’কে পরিবেশন করেন। এর পর থেকেই নাগরিক সভ্যতার করালগ্রাসে ম্রিয়মাণ আদিবাসী; ধর্মীয় বিবেচনায় নিচু জাত, অর্থবিত্তের নিরিখে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত ও দুর্বল মানুষগুলো উপন্যাসে স্থান পাওয়া শুরু করে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই লেখকের হৃদয়ধর্মে সঙ্গে যুক্ত হয় লেখকের বুদ্ধিবৃত্তি। চিন্তা ও কল্পনার গভীরতা দিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রবেশ করলেন নিম্নবর্গে জীর্ণ বাসগৃহে, কখনো কখনো অশান্ত অন্তর্লোকে। ফলে ক্রমেই উদ্ভাসিত হলো নিম্নবগেরু অন্তর্গত গভীর-বিস্তৃত সাংস্কৃতিক বিশ্ব, যা বাংলা উপন্যাসের জগেক করে তুলল বিস্তৃত ও সমগ্রতাসন্ধানী। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এভাবে উপেতি নিম্নবর্গে প্রতি গভীর অনুসন্ধানী দৃষ্টি ফেললেন উপন্যাসের জমিনে এবং তাঁদের চারপাশের চেনাজানা সমাজে আর শতাব্দীব্যাপী অবহেলিত দুঃখে-সুখে মূক অখ্যাত নিম্নবর্গে প্রতি।
ব্যক্তিজীবনে অভিজাত এবং জন্মসূত্রে উঁচু জাতের বাংলা ঔপন্যাসিকরা নিম্নবর্গকে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করে তাদের নিয়ে গল্পকথা সৃষ্টি করেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেই এ ব্যর্থতার স্বীকৃতি দিয়েছেন- ‘মাঝে মাঝে গেছি আমি ও পাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে। ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিল না একেবারে (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ঐকতান’, জন্মদিনে)।’ শৈলজানন্দের সঙ্গে ‘কয়লাকুঠি’ গল্পের প্রসঙ্গেও রবীন্দ্রনাথ এ কথা স্বীকার করেন, ‘আমরা দোতালার জানালা দিয়ে গরিবদের দেখেছি, তুমি তাঁদের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে তাদের সুখ-দুঃখ অনুভব করেছো গভীর ভাবে’
বুদ্ধির সাহায্যে নিম্নবর্গকে উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। নিম্নবর্গ চরিত্র সৃজনে তাঁর পদ্মানদীর মাঝি বাংলা উপন্যাসে একটি অভিনব সৃষ্টি। পদ্মানদীর মাঝির আগেও উপন্যাসে পার্শ্বচরিত্র সূত্র ধরে শ্রমজীবী মানুষের আত্মপ্রকাশের অবকাশ ঘটলেও কিন্তু শ্রমজীবী শ্রেণীর বাস্তব জীবনবোধ প্রাধান্য পেল পদ্মানদীর মাঝিতে। পূর্বে নিম্নবর্গ উপস্থাপন প্রক্রিয়াকে মানিক নিজেই সমালোচনা করেছেন। ‘শৈলজানন্দের গ্রাম্যজীবন ও কয়লাখনির জীবনের ছবি হয়েছে অপরূপ-কিন্তু‘ শুধু ছবি হয়েছে। বৃহত্তর জীবনের সঙ্গে এর বাস্তব সংঘাত আসেনি। বস্তিজীবন এসেছে কিন্তু‘ বস্তিজীবনের বাস্তবতা আসেনি- বস্তির মানুষ ও পরিবেশকে আশ্রয় করে রূপ নিয়েছে মধ্যবিত্তের রোমান্টিক ভাবাবেগ’ । পদ্মানদীর মাঝির কেন্দ্রীয় চরিত্ররা সকলেই পদ্মাতীরের মাঝি, জেলে-ধীবর ও অন্যান্য নিম্নবর্ণের সম্প্রদায় ও এর সমস্ত ঘটনাই তাদের জীবন-নির্ভর। কুবের, কপিলা, মালা, রাসু, আমিনুদ্দী প্রমুখ নিম্নবর্গীয় সবাই এই জীবন নাট্যের কুশীলব। মানিক সচেতনভাবে উপন্যাসে নিম্নশ্রেণীর মানুষের জীবনবোধকে উপন্যাসে স্থান দিয়েছেন। ‘ঈশ্বর থাকেন ঐ ভদ্রপল্লীতে’- ঔপন্যাসিক নিজে ভদ্রপল্লীতে বাস করে এ উক্তি করছেন। বুদ্ধি ও চিন্তার সারবত্তা দিয়ে নিম্নবগেরু ব্যক্তিজীবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছেন।
ফ্রয়েডীয় চেতনা
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনের প্রথম পর্বে মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড, ইয়ুং, অ্যাডলার প্রমুখ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি মার্কসবাদে দীক্ষা নেন। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কমিউনিস্ট পাট্রির সক্রিয় সদস্য হন এবং আমৃত্যু এই দলের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। সাহিত্যের মাধ্যমে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের বিশ্লেষণ এবং মানুষের মনোরহস্যের জটিলতা উন্মোচনে তিনি ছিলেন একজন দক্ষশিল্পী। শহরের পাশাপাশি গ্রামজীবনের দ্বন্দ্বসঙ্কুল পটভূমিও তাঁর উপন্যাস ও গল্পে গুরুত্ব পেয়েছে। অর্ধশতাধিক উপন্যাস ও দুশো চবিবশটি গল্প তিনি রচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গন্থ: উপন্যাস জননী (১৯৩৫), দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫), পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬), শহরতলী (১৯৪০-৪১), চিহ্ন (১৯৪৭), চতুষ্কোণ (১৯৪৮), সার্বজনীন (১৯৫২), আরোগ্য (১৯৫৩) প্রভৃতি; আর ছোটগল্প অতসী মামী ও অন্যান্য গল্প (১৯৩৫), প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭), সরীসৃপ (১৯৩৯), সমুদ্রের স্বাদ (১৯৪৩), হলুদ পোড়া (১৯৪৫), আজ কাল পরশুর গল্প (১৯৪৬), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৫০), ফেরিওয়ালা (১৯৫৩) ইত্যাদি।
পদ্মানদীর মাঝি ও পুতুলনাচের ইতিকথা উপন্যাস দুটি তাঁর বিখ্যাত রচনা। এ দুটির মাধ্যমেই তিনি সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
সাহিত্য বিশ্লেষণ করতে গেলে হয়তো অস্তিত্ববাদ, মার্ক্সবাদ, সাইকো-অ্যানালাইসিস প্রভৃতি প্রপঞ্চকে ডেকে আনতে হয় বটে, তবু মানিক স্বনির্ভর, মৌলিক, আপন শক্তিতে জ্বলছেন। এর কারণ মানুষের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। কেন লিখি এই প্রশ্নের জবাবে তাঁর স্পষ্ট উত্তর: লেখা ছাড়া অন্য কোনো উপায়েই যেসব কথা জানানো যায় না, সেই কথাগুলো জানাবার জন্যই আমি লিখি। সাহিত্যের যে দায় লেখককে ফুল-নদী-পাখি থেকে বিমুখ করে মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, মানিক তার সবটাই পূর্ণ করেছেন কথার বয়নে।
প্রাগৈতিহাসিক গল্পের ভিখু নিম্নবর্গেরও নিম্নতর, এই গল্পের মাধ্যমে ভারতবর্ষীয় শ্রেণীসংঘাত নয় বরং ব্যক্তিমানুষের বৈকল্য ও স্বাভাবিকতার দ্বন্দ্বকে উন্মোচন করতে চেয়েছেন। ফ্রয়েডীয় মনোসমীণকে সাহিত্যে অবলোকন বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে অত সহজ ছিল না। একথা নিঃসংশয়ে বলা যায়, মানিকের প্রায় সকল সৃষ্টি বিশ্বমানের। ভিখুর লালসা ও কামনাকে অঙ্কন গড় কথাকারের পক্ষে সম্ভব নয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ভিখুর অন্তর্লোকে প্রবেশ করে দেখেছেন মানবমনের চাওয়া ও বৈচিত্র্য-অভিসারী গন্তব্যকে। সে কারণে প্রবাদসম উক্তি করেছেন: ‘পায়েনি তুই ব্যথা পাস পাঁচী’। এক ভয়ঙ্কর ডাকাতও খুনের মাধ্যমে লুট করা প্রেমিকার প্রতি দরদি ও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। মানুষের মনের অতল গহ্বরে ডুব দিয়ে ফ্রয়েডের তত্ত্বের উত্কৃষ্ট প্রয়োগ দেখিয়েছেন সাহিত্যে। মন বর্ণনা করতে গিয়ে প্রায়ই স্মরণীয় সব চরণের অবতারণা করেছেন, যা একাধারে কাব্যিকতায় মোহমুগ্ধকর। প্রাগৈতিহাসিক গল্পের শেষ লাইনে মানবজীবনের অবচেতন মনের দার্শনিক সত্যকে উদ্ভাসিত করেছেন: ‘কিন্তু যে ধারাবাহিক অন্ধকার মাতৃগর্ভ হইতে সংগ্রহ করিয়া দেহের অভ্যন্তরে লুকাইয়া ভিখু ও পাঁচী পৃথিবীতে আসিয়াছিল এবং যে অন্ধকার তাহারা সন্তানের মাংসল আবেষ্টনীর মধ্যে গোপন রাখিয়া যাইবে তাহা প্রাগৈতিহাসিক, পৃথিবীর আলো আজ পর্যন্ত তাহার নাগাল পায় নাই, কোনোদিন পাইবেও না।’ কেবল সামষ্টিক সমাজ বা শ্রেণী চেতনা নয়, ব্যক্তির গহিন অন্ধকারেও মানিক ডুব দিয়েছেন অসংখ্যবার। কথাকার মানিকের এ আরো একটি সফলতা।
জনপ্রিয় পুতুল নাচের ইতিকথায় শশী-কুসুম সম্পর্ককে শারীরবৃত্তীয় জটিলতা থেকে ঊর্ধ্বে নিয়ে দেখিয়েছেন, মন মানুষের জটিলতার কেন্দ্র, শরীর কেবল বাহ্যিক আবরণ। কুসুমের অনুবেদনে উঠে আসে যে মানুষ শেষ পর্যন্ত মনের বৈচিত্র্য অন্বেষণের নিকট পরাজিত: ‘স্পষ্ট করে ডাকা দূরে থাক, ইশারা করে ডাকলে ছুটে যেতাম তখন। আজ হাত ধরে টানলেও আমি যাব না। কেন যাব? লাল টকটক করে তাতানো লোহা ফেলে রাখলে তাও আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে যায়, যায় না? সব ভোঁতা হয়ে গেছে ছোটবাবু। লোকের মুখে মন ভেঙে যাবার কথা শুনতাম; অ্যাদ্দিনে বুঝতে পেরেছি, সেটা কী।’ দেবদাস-পার্বতীর পাঠক যখন শরত্চন্দ্রের চরিত্রদের অনুকথনে-অনুবর্তনে কান্ত তখনই জীবনকে দেখার বৈজ্ঞানিক নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হাজির হলেন। তাই তার শশী ইচ্ছে করলেও নিজের ভুবন ও বৃত্ত ভাঙতে পারে না।
আমাদের মধ্যে একটি সাধারণ বিশ্বাস জন্মেছে যে, সাহিত্যের যেকোনো প্রবণতা প্রথমে পশ্চিমে জনপ্রিয়তা পাবে। তার পর প্রশান্ত মহাসাগর ও অতলান্তিকের ঢেউ পেরিয়ে ভারতবর্ষে দারুণ ফেনিল গর্ব নিয়ে আছড়ে পড়বে। এই ধারাবাহিকতায় আধুনিক সাহিত্য বিশেষ করে কবিতা-উপন্যাসের যেকোনো প্রবণতাকে ধরে নেয়া হয়, পশ্চিমের পর পূর্বে তথা উপনিবেশিত অঞ্চলে জনপ্রিয়তা পাবে। এই অভ্যাসবশত আলব্যের কামু দ্বারা প্রভাবিত মানিক- এমন একটি মিথ চালু হয়েছিল। কিন্তু মানিকের শশী কামুর রিও-এর পূর্বজ, তদ্রূপ গাওদিয়ার সংকট ওরানের চেয়ে আগের, মূলত মানিকই পথিকৃত্। পুতুল নাচের ইতিকথা আলব্যের কামুর উপন্যাসগুলোর পূর্বে লিখিত। অনুকরণের যে রীতি ও এই রীতির ফলে সমালোচকদের পূর্বানুমানের রীতি বাঙালিরা চালু করেছিল- তা মানিকের বেলায় খাটে না। মানিক ইউরোপকে কখনই অন্ধ অনুকরণ করেননি।
মানিক তাই বিবরণধর্মী কথাকারদের বিপরীতে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছেন। জীবনকে যে সরল মুকুর ছাড়াও দেখা যায়, অসংখ্য অবতল-উত্তল দৃক ছাড়াও অবচেতনের আরেক দুনিয়ার মাধ্যমে চরিত্রেরা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে, মানিকের মতো এত স্পষ্ট করে আর কেউ অঙ্কন করেননি। ক্রমাগত ভার্চুয়াল সার্ফিংয়ের জগতে পাঠকেরা যখন সাহিত্যের অসংখ্য বিকল্পের মধ্যে হাতড়ে বেড়ান জীবনের প্রতীতি, তখনই ক্যালেন্ডারের পাতা বদলানোর অজুহাতে হলেও ঠিকই স্মরণ করতে হয় মানিক-নক্ষত্রকে। এই নক্ষত্র আমাদের আলোকিত করে যাচ্ছে শতাব্দী পেরিয়ে। বুদ্ধির সাহায্যে নিম্নবর্গকে উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। নিম্নবর্গ চরিত্র সৃজনে তাঁর পদ্মানদীর মাঝি বাংলা উপন্যাসে একটি অভিনব সৃষ্টি। পদ্মানদীর মাঝির আগেও উপন্যাসে পার্শ্বচরিত্র সূত্র ধরে শ্রমজীবী মানুষের আত্মপ্রকাশের অবকাশ ঘটলেও কিন্তু শ্রমজীবী শ্রেণীর বাস্তব জীবনবোধ প্রাধান্য পেল পদ্মানদীর মাঝিতে। পূর্বের নিম্নবর্গ উপস্থাপন প্রক্রিয়াকে মানিক নিজেই সমালোচনা করেছেন। ‘শৈলজানন্দের গ্রাম্যজীবন ও কয়লাখনির জীবনের ছবি হয়েছে অপরূপ—কিন্তু শুধু ছবি হয়েছে। বৃহত্তর জীবনের সঙ্গে এর বাস্তব সংঘাত আসেনি। বস্তিজীবন এসেছে কিন্তু বস্তিজীবনের বাস্তবতা আসেনি— বস্তির মানুষ ও পরিবেশকে আশ্রয় করে রূপ নিয়েছে মধ্যবিত্তের রোমান্টিক ভাবাবেগ’ (লেখকের কথা, ১৯৫৭)। পদ্মানদীর মাঝির কেন্দ্রীয় চরিত্ররা সকলেই পদ্মাতীরের মাঝি, জেলে-ধীবর ও অন্যান্য নিম্নবর্ণের সম্প্রদায় ও এর সমস্ত ঘটনাই তাদের জীবন-নির্ভর। কুবের, কপিলা, মালা, রাসু, আমিনুদ্দী প্রমুখ নিম্নবর্গীয় সবাই এই জীবন নাট্যের কুশীলব। মানিক সচেতনভাবে উপন্যাসে নিম্নশ্রেণীর মানুষের জীবনবোধকে উপন্যাসে স্থান দিয়েছেন। ‘ঈশ্বর থাকেন ঐ ভদ্রপল্লীতে’— ঔপন্যাসিক নিজে ভদ্রপল্লীতে বাস করে এ উক্তি করছেন। বুদ্ধি ও চিন্তার সারবত্তা দিয়ে নিম্নবর্গের ব্যক্তিজীবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছেন।
প্রাগৈতিহাসিক গল্পের ভিখু নিম্নবর্গেরও নিম্নতর, এই গল্পের মাধ্যমে ভারতবর্ষীয় শ্রেণীসংঘাত নয় বরং ব্যক্তিমানুষের বৈকল্য ও স্বাভাবিকতার দ্বন্দ্বকে উন্মোচন করতে চেয়েছেন। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণকে সাহিত্যে অবলোকন বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে অত সহজ ছিল না। একথা নিঃসংশয়ে বলা যায়, মানিকের প্রায় সকল সৃষ্টি বিশ্বমানের। ভিখুর লালসা ও কামনাকে অঙ্কন গড় কথাকারের পক্ষে সম্ভব নয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ভিখুর অন্তর্লোকে প্রবেশ করে দেখেছেন মানবমনের চাওয়া ও বৈচিত্র্য-অভিসারী গন্তব্যকে। সে কারণে প্রবাদসম উক্তি করেছেন: ‘পায়েনি তুই ব্যথা পাস পাঁচী’। এক ভয়ঙ্কর ডাকাতও খুনের মাধ্যমে লুট করা প্রেমিকার প্রতি দরদি ও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। মানুষের মনের অতল গহ্বরে ডুব দিয়ে ফ্রয়েডের তত্ত্বের উত্কৃষ্ট প্রয়োগ দেখিয়েছেন সাহিত্যে। মন বর্ণনা করতে গিয়ে প্রায়ই স্মরণীয় সব চরণের অবতারণা করেছেন, যা একাধারে কাব্যিকতায় মোহমুগ্ধকর। প্রাগৈতিহাসিক গল্পের শেষ লাইনে মানবজীবনের অবচেতন মনের দার্শনিক সত্যকে উদ্ভাসিত করেছেন: ‘কিন্তু যে ধারাবাহিক অন্ধকার মাতৃগর্ভ হইতে সংগ্রহ করিয়া দেহের অভ্যন্তরে লুকাইয়া ভিখু ও পাঁচী পৃথিবীতে আসিয়াছিল এবং যে অন্ধকার তাহারা সন্তানের মাংসল আবেষ্টনীর মধ্যে গোপন রাখিয়া যাইবে তাহা প্রাগৈতিহাসিক, পৃথিবীর আলো আজ পর্যন্ত তাহার নাগাল পায় নাই, কোনোদিন পাইবেও না।’ কেবল সামষ্টিক সমাজ বা শ্রেণী চেতনা নয়, ব্যক্তির গহিন অন্ধকারেও মানিক ডুব দিয়েছেন অসংখ্যবার। কথাকার মানিকের এ আরো একটি সফলতা। জনপ্রিয় পুতুল নাচের ইতিকথায় শশী-কুসুম সম্পর্ককে শারীরবৃত্তীয় জটিলতা থেকে ঊর্ধ্বে নিয়ে দেখিয়েছেন, মন মানুষের জটিলতার কেন্দ্র, শরীর কেবল বাহ্যিক আবরণ। কুসুমের অনুবেদনে উঠে আসে যে মানুষ শেষ পর্যন্ত মনের বৈচিত্র্য অন্বেষণের নিকট পরাজিত: ‘স্পষ্ট করে ডাকা দূরে থাক, ইশারা করে ডাকলে ছুটে যেতাম তখন। আজ হাত ধরে টানলেও আমি যাব না। কেন যাব? লাল টকটক করে তাতানো লোহা ফেলে রাখলে তাও আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে যায়, যায় না? সব ভোঁতা হয়ে গেছে ছোটবাবু। লোকের মুখে মন ভেঙে যাবার কথা শুনতাম; অ্যাদ্দিনে বুঝতে পেরেছি, সেটা কী।’ দেবদাস-পার্বতীর পাঠক যখন শরৎচন্দ্রের চরিত্রদের অনুকথনে-অনুবর্তনে ক্লান্ত তখনই জীবনকে দেখার বৈজ্ঞানিক নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হাজির হলেন। তাই তার শশী ইচ্ছে করলেও নিজের ভুবন ও বৃত্ত ভাঙতে পারে না।
আমাদের মধ্যে একটি সাধারণ বিশ্বাস জন্মেছে যে, সাহিত্যের যেকোনো প্রবণতা প্রথমে পশ্চিমে জনপ্রিয়তা পাবে। তার পর প্রশান্ত মহাসাগর ও অতলান্তিকের ঢেউ পেরিয়ে ভারতবর্ষে দারুণ ফেনিল গর্ব নিয়ে আছড়ে পড়বে। এই ধারাবাহিকতায় আধুনিক সাহিত্য বিশেষ করে কবিতা-উপন্যাসের যেকোনো প্রবণতাকে ধরে নেয়া হয়, পশ্চিমের পর পূর্বে তথা উপনিবেশিত অঞ্চলে জনপ্রিয়তা পাবে। এই অভ্যাসবশত আলব্যের কামু দ্বারা প্রভাবিত মানিক— এমন একটি মিথ চালু হয়েছিল। কিন্তু মানিকের শশী কামুর রিও-এর পূর্বজ, তদ্রুপ গাওদিয়ার সংকট ওরানের চেয়ে আগের, মূলত মানিকই পথিকৃত্। পুতুল নাচের ইতিকথা আলব্যের কামুর উপন্যাসগুলোর পূর্বে লিখিত। অনুকরণের যে রীতি ও এই রীতির ফলে সমালোচকদের পূর্বানুমানের রীতি বাঙালিরা চালু করেছিল— তা মানিকের বেলায় খাটে না। মানিক ইউরোপকে কখনই অন্ধ অনুকরণ করেননি। তার সাহিত্য বিশ্লেষণ করতে গেলে হয়তো অস্তিত্ববাদ, মার্ক্সবাদ, সাইকো-অ্যানালাইসিস প্রভৃতি প্রপঞ্চকে ডেকে আনতে হয় বটে, তবু মানিক স্বনির্ভর, মৌলিক, আপন শক্তিতে জ্বলছেন। এর কারণ মানুষের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। কেন লিখি এই প্রশ্নের জবাবে তাঁর স্পষ্ট উত্তর: লেখা ছাড়া অন্য কোনো উপায়েই যেসব কথা জানানো যায় না, সেই কথাগুলো জানাবার জন্যই আমি লিখি। সাহিত্যের যে দায় লেখককে ফুল-নদী-পাখি থেকে বিমুখ করে মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, মানিক তার সবটাই পূর্ণ করেছেন কথার বয়নে।
মানিক তাই বিবরণধর্মী কথাকারদের বিপরীতে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছেন। জীবনকে যে সরল মুকুর ছাড়াও দেখা যায়, অসংখ্য অবতল-উত্তল দৃক ছাড়াও অবচেতনের আরেক দুনিয়ার মাধ্যমে চরিত্রেরা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে, মানিকের মতো এত স্পষ্ট করে আর কেউ অঙ্কন করেননি। ক্রমাগত ভার্চুয়াল সার্ফিংয়ের জগতে পাঠকেরা যখন সাহিত্যের অসংখ্য বিকল্পের মধ্যে হাতড়ে বেড়ান জীবনের প্রতীতি, তখনই ক্যালেন্ডারের পাতা বদলানোর অজুহাতে হলেও ঠিকই স্মরণ করতে হয় মানিক-নক্ষত্রকে। এই নক্ষত্র আমাদের আলোকিত করে যাচ্ছে শতাব্দী পেরিয়ে।

