বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিড়াল প্রবন্ধটির মূল বক্তব্য আলোচনা কর।
সাহিত্য সম্রাট উপাধিতে ভূষিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। প্রথম সার্থক উপন্যাসের স্রষ্টা হিসেবে তিনি সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। উপন্যাসের মতো তিনি প্রবন্ধ সাহিত্যেও সসফলতার পরিচয় রেখেছেন। তাঁর রচিত হাস্যরসাত্মক ও ব্যঙ্গধর্মী রচনাগুলো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন। তিনি ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, ভাষা ও সমাজ বিষয়ক বহু প্রবন্ধ রচনা করেছেন। ‘সাম্য’, ‘কৃষ্ণচরিত্র’, ‘লোকরহস্য’, ‘বিজ্ঞানরহস্য’, ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ ইত্যাদি তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ বঙ্কিমের বিড়াল-প্রবন্ধ এক বিশিষ্ট রচনা। এ রচনাকর্মের মূল বক্তব্য নিম্নে আলোচনা করা হলো-
বিড়াল প্রবন্ধ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত রম্যব্যঙ্গ রচনা সংকলন ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ -এর অন্তর্গত। বাংলা সাহিত্যে এক ধরনের হাস্যরসাত্নক রঙ্গব্যঙ্গমূলক রচনার ভিতর দিয়ে তিনি পরিহাসের মাধ্যমে সমকালীন সমাজ, ধর্ম, সভ্যতা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতার তীব্র সমালোচনা করেছেন। ‘বিড়াল’ নকশা জাতীয় ব্যঙ্গ রচনা। এতে লেখক একটি ক্ষুধার্ত বিড়াল আফিংখোর কমলাকান্তের জন্য রেখে দেওয়া দুধ চুরি করে খেয়ে ফেলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য এবং সমাজের নানা অসংগতিকে ইঙ্গিত করেছেন। দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার, ধনীর ধনে গরিবের অধিকার, ক্ষুধার্ত অবস্থায় মানুষের আচরণ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক উপস্থাপন করে লেখক সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে তাঁর সমর্থন জানিয়েছেন। বিড়ালকে প্রহার করার জন্য উদ্যত হয়ে কমলাকান্ত নিজেই দুর্বল ক্ষুধার্ত বিড়ালের পক্ষ অবলম্বন করে যুক্তিতর্ক দাঁড় করেছেন। খাবার মাত্রেই ক্ষুধার্তের অধিকার আছে। তা ধনীর কি দরিদ্রের সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। যদি ধনীর হয় তবে তা স্বেচ্ছায় না দিলে ক্ষুধার্ত তা যে কোনো উপায়ে সংগ্রহ করবে, প্রয়োজনে চুরি করে খাবে, তাতে বিশেষ কোনো দোষ নেই। বিড়ালের এই যুক্তিকে শেষ পর্যন্ত কমলাকান্ত অস্বীকার করতে পারেননি। বিড়াল তাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় যে, এ সংসারে ক্ষীর, সর, দুগ্ধ, দধি, মৎস্য, মাংস সবকিছুতেই তাদের অধিকার আছে। এ কথায় পৃথিবীজুড়ে যত ধন-সম্পদ আছে তাতে দরিদ্র মানুষের অধিকারের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিড়াল সাধ করে চোর হয়নি। তার জিজ্ঞাসা, খেতে পেলে কে চোর হয় ? বড় বড় সাধু চোর অপেক্ষা যে অধার্মিক সেই বিষয়ে বিড়াল তার যুক্তি তুলে ধরেছে। বিড়ালের স্পষ্ট উচ্চারণ- অধর্ম চোরের নয়, চোরে যে চুরি করে সে অধর্ম কৃপণ ধনীর। কমলাকান্ত নিজেই নিজের মনে বিড়ালের পক্ষে এবং নিজের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। বিড়ালের কথাগুলো সোশিয়ালিস্টিক, সমাজ বিশৃঙ্খলার মূল। এভাবে তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রধান অন্তরায়গুলো আমাদের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একজন সচেতন শিল্পী। তিনি সমাজে নিম্নশ্রেণির দরিদ্র উপর উচ্চশ্রেণির অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার ও দোষ চাপানোর বিষয়টিকে ব্যঙ্গ করেছেন ‘বিড়াল’ রচনায়। এই রচনায় বিড়াল নিম্নশ্রেণির দরিদ্র ভুখা মানুষের প্রতিনিধি আর কমলাকান্ত যতক্ষণ পর্যন্ত ধনীর ধনবৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি দেখান ততক্ষণ পর্যন্ত মনুষ্য সমাজের অন্যায়কারী ধনী চরিত্রের প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত। ‘বিড়াল’ রচনায় লেখক ‘কেহ মরে বিল ছেঁচে, কেহ খায় কই’, ‘তেলা মাথায় তেল দেওয়া’ প্রভূতি প্রবাদ বাক্য ব্যবহার করে শ্রমিকরা কীভাবে ফল ভোগ থেকে বঞ্চিত হয় সেই দিকে ইঙ্গিত করেছেন। মূলত জগৎসংসারে ধর্মের দোহাই দিয়ে, অন্যায়-প্রতিকারের বিধান দিয়ে মানুষের কল্যাণ সাধন সম্ভব নয়। জগতের মানুষের কল্যাণ করতে হলে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের অবসান করে মানবকল্যাণে আত্মনিবেদন করতে হবে। এই বিশেষ আবেদনই ‘বিড়াল’ রচনায় হাস্যরসের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
‘বিড়াল’ এক ধরনের হাস্যরসাত্মক নকশা জাতীয রচনা। আলোচ্য রচনায় গল্প-উপন্যাসের মতো বিস্তৃত ও গভীর তাৎপর্যময় ছবি না একে লেখক যখন তার খসড়া একটি ছবি আঁকেন অল্প কিছু রেখায়, তখন তাকে বলা হয় নকশা। হাস্যরসের মাধ্যমে বিড়াল নামক এক প্রাণীর মুখ দিয়ে সমাজের দরিদ্র, ক্ষুধার্ত মানুষের অধিকারের মর্ম বক্তব্য লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। এ সব দিক থেকে ‘বিড়াল’ নকশা জাতীয় রচনার বৈশিষ্ট্য বহন করছে। এ রচনার প্রথমাংশ নিখাদ হাস্যরসাত্মক, পরের অংশ গূঢ়ার্থে সন্নিহিত।
‘বিড়াল’ প্রবন্ধে দুটি চরিত্র রয়েছে। বিড়াল ও কমলাকান্ত। বিড়াল এ রচনার প্রধান ও প্রতীকী চরিত্র। সমাজের নিম্নবিত্ত, অসহায়, বঞ্চিত, ক্ষুধার্ত, মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে বিড়ালকে। এর কথা ও যুক্তিতে পর্যুদস্ত হয়েছে কমলাকান্ত। কমলাকান্ত আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকলেও সমাজ সচেতন ও উদার মানুষ। দয়ালু ও সৎ মানুসিকতার অধিকারী এ চরিত্রটি ‘বিড়াল’ রচনায় সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেছে।
উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনায় দেখা যায় যে, ‘বিড়াল’ রচনার মাধ্যমে লেখক সমাজের প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তি ও অবহেলিত দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে পার্থক্য ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যন্ত সুচারুভাবে। সেই সঙ্গে বঞ্চিতজনের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক সাম্যের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন।
সালেক শিবলু এমফিল, গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।


 
                        