‘রসাত্মক বাক্যই কাব্য’-আলোচনা কর।
সাহিত্যের প্রাচীনতম শাখা হলো কাব্য। কিন্তু ‘কাব্য’ কী এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। রামায়ণের রচয়িতা আদি কবি বাল্মীকি থেকে শুরু করে আধুনিক কাল পর্যন্ত অনেক বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি এ বিষয়ে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাদের মধ্যে ভরত, দ-ী, বামন, আনন্দবর্ধন, জগন্নাথ, অভিনব গুপ্ত, বিশ্বনাথ কবিরাজ অন্যতম। এ সব ব্যক্তি সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রে বিশেষ অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। এ জন্য তাদেরকে আচার্য বলা হয়। তারা প্রায় সবাই বাংলা কাব্যে রসের গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। ভরত ‘নাট্যশাস্ত্র’ গ্রন্থে ‘রস’কে কাব্যের মূল বলে মতামত দিয়েছেন।
‘রস’ সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে। √রস্+অ=রস এভাবে প্রত্যয়যোগে শব্দটি গঠিত হয়েছে। অলংকারশাস্ত্রে ‘বাক্য’ বলতে কাব্য বা কবিতাকে বোঝায়। বাক্যে রস থাকলেই তাকে কাব্য বলা যায়। রস ছাড়া কোন বাক্য কাব্য হয় না। বাংলায় অনেক রসহীন কাব্য রয়েছে। এগুলোকে চিত্রকাব্য বলা হয়। তবে এগুলো দূর্বল শ্রেণির কাব্য। উৎকৃষ্ট কাব্যে অবশ্যই রস থাকতে হবে। যে বাক্য থেকে রস আস্বাদন করা যায় তাকেই কাব্য বলা হয়। বিশ্বনাথ কবিরাজ ‘রসতত্ত্ব’ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেছেন এবং রসাত্মক বাক্যই কাব্য বলে মতামত দিয়েছেন।
রসের সঙ্গে ভাবের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। ‘ভাব’ সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শব্দটি সংস্কৃত ‘ভূ’ ধাতু থেকে সৃষ্টি হয়েছে। শব্দটি প্রত্যয় যোগে গঠিত হয়েছে এভাবে √ভূ+অ=ভাব, শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো জন্ম, সৃষ্টি, উৎপত্তি ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থ হলো মানবমনের অবস্থা, অভিপ্রায়, প্রবণতা, মনের গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি। অলংকার শাস্ত্র অনুযায়ী ‘ভাব’ শব্দ দ্বারা মানবমনের নানা রকম প্রবৃত্তিকে বোঝায়। ‘রসতত্ত্ব’-এ ‘ভাব’ শব্দ দ্বারা রতি বা নর-নারীর আসক্তি, প্রেম, অনুরাগ ইত্যাদিকে বোঝায়। অলংকার শাস্ত্রে অনেক রকম ভাব আছে। যেমন বিভাব, অনুভাব, সঞ্চারী ভাব ইত্যাদি। এ সব ভাব থেকে রসের উৎপত্তি হয়। আলংকারিকদের মতে স্থায়ীভাব নয়টি। এ গুলো : রতি, হাস, শোক, ক্রোধ, উৎসাহ, ভয়, জুগুপ্সা, বিষ্ময় ও শম ভাব। এ গুলো মানবমনের নানা রকম অবস্থা। কবি তো কাব্যে মনের এ সব অবস্থাই নানা রকম অলংকার-উপমা সহকারে তুলে ধরেন। পাঠক যখন কাব্য পাঠ করে, তখন তার মধ্যে এ ভাব সঞ্চার হয়, এ ভাব থেকেই রসের উৎপত্তি হয়। পাঠক তো কাব্য থেকে এ রসই আস্বাদন করতে চায়। তাই আলংকারিকরা বলেন যে, রসাত্মক বাক্যই কাব্য।
কবির মনে একটি ভাবের উদয় হয়। তিনি এ ভাব কবিতায় প্রকাশ করেন, কবির উদ্দেশ্য তার মনের ভাবটি পাঠকের মধ্যে সঞ্চার করা। পাঠক যখন এ কাব্য পড়ে রস পেয়ে তৃপ্তি লাভ করে, তখন তাকে সার্থক কাব্য বলা হয়। ফলে রসই কাব্যের প্রধান বিষয়। আর এ কারণেই ভরত রসকে কাব্যের প্রাণ বলেছেন। আর আনন্দ বর্ধন রসকে কাব্যের আত্মা বলেছেন। অভিনব গুপ্ত সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি কাব্যসাহিত্যে রসের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন এবং স্বীকার করেছেন যে, রস ছাড়া কোন কাব্য হতে পারে না।
‘রস’ কাব্যের অপরিহার্য উপাদান। রস কাব্যের এমন একটি উপাদান যা পাঠ করে পাঠক ভাবে তন্ময় হয়ে যায়। রসের কারণেই ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ ইত্যাদি লাভ হয়। মানুষ সব সময় সুন্দরের পুজারী। মানুষ সৌন্দর্য উপভোগ করতে চায়। কাব্যরস মানবমনের এই চিরন্তন সৌন্দর্যের তৃষ্ণা মেটায়। কাব্যের ভাব রসের মাধ্যমে পাঠকের হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়। সুতরাং রস কাব্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং এই রস কাব্যের দেহে যুক্ত হয়ে পাঠকের মনে আনন্দ, বেদনা, হর্ষ, বিষাদ ইত্যাদি জাগিয়ে তুলে পাঠকের মনে তৃপ্তি সাধন করে। তাছাড়া উপমহাদেশের ধর্ম ও দর্শন শাস্ত্রের প-িতরাও রসের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বের বিষয় বর্ণনা করেছেন। ব্রহ্মার স্বরুপ বিশ্লেষণে ঋষিগণ ‘রস’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
উপর্যুক্ত আলোচনার মাধ্যমে কাব্যে রসের গুরুত্ব সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ভরত প্রথম দিকে ‘রসতত্ত্ব’ বিষয়ে নানা রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন এবং কাব্যসাহিত্যে রসের গুরুত্ব বর্ণনা করেন। পরবর্তী সময়ে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের অনান্য বিশেষজ্ঞ প-িত রসবাদের সমর্থনে নিজেদের মতামত উপস্থাপন করেন এবং প্রায় সব আলংকারিক স্বীকার করেছেন যে, অলংকার শাস্ত্রে রস একটি মুখ্য বিষয়। রস ছাড়া কাব্য হতে পারে না। তাই এ কথা যথার্থ বলা হয়েছে যে, রসাত্মক বাক্যই কাব্য।