বিভিন্ন ধরনের শব্দালংকারের পরিচয় দাও।
শব্দের ধ্বনির সাহায্যে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে যে অলংকার তাকে শব্দালঙ্কার বলে। জীবেন্দ্র সিংহ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শব্দের ধ্বনি রূপের আশ্রয়ে যে সমস্ত অলঙ্কার সৃষ্টি হয়, তাহাদের শব্দালঙ্কার বলে।’ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘যাহা দ্বারা শব্দের চমৎকারিত্ব বর্ধিত হয়, তাহাকে শব্দালঙ্কার বলে।’ উদাহরণ – ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদীশার নিশা।’ জীবনানন্দ দাশ এখানে ‘র’ ধ্বনি চারবার ব্যবহার করেছেন। ফলে ধ্বনিমাধুর্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শব্দালঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে।
শব্দালঙ্কার নানা ধরনের হয়ে থাকে। নিম্নে বিভিন্ন ধরনের শব্দালঙ্কারের পরিচয় সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো-
১.অনুপ্রাস : একই ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছের পুনঃপুনঃ বিন্যাসকে অনুপ্রাস বলে। অনুপ্রাস সাধারণত শব্দের প্রথমে, মাঝে ও শেষে থাকে। উদাহরণ-
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখন অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
বিশ্লেষণ : এখানে ‘ঙ্গ’ এবং ‘ন্ধ’ ধ্বনি দুবার ব্যবহৃত হয়েছে এবং শ্রুতিমাধুর্য সৃষ্টি হয়েছে।
২.যমক : একই শব্দ বিভিন্ন অর্থে পুনরাবৃত্ত হলে তাকে যমক অলঙ্কার বলে। যমক অর্থ যুগ্ম। শব্দটি সাধারণত দুবার প্রয়োগ হয় বলেই এ নাম হয়েছে। তবে যমকের একই শব্দ দুবারের বেশি ব্যবহৃত হতে পারে। একই শব্দ একই স্থানে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে একাধিকবার প্রয়োগই যমক। এই অলঙ্কার স্বাধীন বা পৃথকভাবে ব্যবহৃত হতে পারে। আবার অন্য অলঙ্কারের সাথে যুক্ত বা একাত্ম হয়েও ব্যবহৃত হতে পারে। শ্লেষের মধ্য দিয়ে বক্তা একটি কথা একবার মাত্র ব্যবহার একাধিক অর্থের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে পারেন। উদাহরণ –
‘ভারত ভারত খ্যাত আপনার গুণে’- (ভারতচন্দ্র)
বিশ্লেষণ : এখানে প্রথম ‘ভারত’ দ্বারা কবি ভারবচন্দ্রকে বুঝিয়েছে, আর দ্বিতীয় ‘ভারত’ দ্বারা ভারতবর্ষকে বুঝিয়েছে।
৩.শ্লেষ : একটি শব্দ একবার মাত্র ব্যবহৃত হয়ে বিভিন্ন অর্থ প্রকাশ করলে তাকে শ্লেষ অলঙ্কার বলে। এই অলঙ্কার স্বাধীন ও পৃথকভাবে ব্যবহৃত হতে পারে আবার অন্য অলঙ্কারের সাথে যুক্ত বা একাত্ম হয়েও ব্যবহৃত হতে পারে। শ্লেষের মধ্য দিয়ে বক্তা একটি কথা একবার মাত্র ব্যবহার করে একাধিক অর্থের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে পারেন। পাঠক বা শ্রোতা সেই ব্যঞ্জনার সন্ধান করবেন। যেমন –
‘কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত ব্যাপ্ত চরাচর,
যাহার প্রভায় প্রভা পায় প্রভাকর। (ঈশ্বর গুপ্ত)
বিশ্লেষণ : ঈশ্বর অর্থ : ভগবান, কবি ঈশ্বর গুপ্ত। প্রভাকর : সূর্য, কবি। এখানে প্রতিটি শব্দই দুইটি অর্থে ব্যহৃত হয়েছে।
৪. বক্রোক্তি : কোন কথা সোজাসুজি না বলে যদি বাঁকা বা ঘুরিয়ে বলা হয় তবে তাকে বক্রোক্তি বলে। বক্রোক্তিতে হা-বোধক প্রশ্নকে না এবং না-বোধক প্রশ্নকে হা-বোধক প্রশ্ন হিসেবে গ্রহণ করে উত্তর দেওয়া যায়। যেমন :
রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী
আমি কি ডরাই, সখি, ভিক্ষারী রাঘবে?’
বিশ্লেষণ : এই উক্তিটি ইতিবাচক হলেও প্রকৃতপক্ষে নেতিবাচক অর্থ প্রকাশ করেছে অর্থাৎ প্রমিলা ভিক্ষারী রাঘবকে ভয় করে না।
৫. পুনরুক্ত বদাভাস : একই অর্থবোধক একাধিক শব্দ যদি একই চরণে ব্যবহৃত হয় এবং তা যদি অর্থ বিশ্লেষণে বিভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে, তাকে পুনরুক্ত বদাভাস বলে। যেমন :
তনু দেহে রক্তাম্বর নীবীবন্ধে বাঁধা
চরণে নূপুরখানি বাজে আধা-আধা। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
বিশ্লেষণ : এখানে ‘তনু’ ও ‘দেহ’ শব্দ দুটির একই অর্থ, কিন্তু কবি তাঁর কবিতায় ‘তনু’ শব্দটিকে ছিপছিপে অর্থে ব্যবহার করেছেন।