সংশপ্তক উপন্যাস অবলম্বনে সেকেন্দার মাস্টার চরিত্রটি বিশ্লেষণ কর।
শহীদুল্লাহ কায়সার (১৯২৭-১৯৭১) সংশপ্তক (১৯৬৫) উপন্যাস রচনা করে বাংলা কথাসাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। এটি একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস। ঢাকা থেকে কোলকাতা পর্যন্ত, এবং বৃটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত এ উপন্যাসের কাহিনি বিস্তৃত। সংশপ্তক উপন্যাস যেমন অনেক ঘটনা সংযুক্ত তেমনই অনেক চরিত্রও আছে। যেমন ফেলু মিঞা, রমযান, লেকু, সেকেন্দার মাস্টার, রামদয়াল, আম্বরী, রাবু, জাহেদ, হুরমতি, মালু, সুলতান, রিহানা ইত্যাদি। এ সব চরিত্রের মধ্যে সেকেন্দার মাস্টার একটি অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র। চরিত্র নির্মাণে লেখক অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। নিম্নে সেকেন্দার মাস্টার চরিত্রটি বিশ্লেষণ করা হলো-
সংশপ্তক উপন্যাস এর কাহিনিসূত্রে আমরা জানতে পারি যে, সেকেন্দার মাস্টার সৈয়দ বাড়িতে থাকে, সেতালতলি গ্রামে শ্যামাচরণ দত্ত উচ্চ ইংরেজি স্কুলের জুনিয়র শিক্ষক। এ কারণেই তাকে মাস্টার বলে ডাকা হয়। অল্প বয়সেই পিতাকে হারায়। তাই নিজেই সংসারের হাল ধরেন। অভাবের কারণে বি. এ পাশ করতে পারে নি। এটা তার মনের দুঃখ। ছোট ভাই সুলতান, ছোট বোন রাসু ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে তার সংসার। নিজে উচ্চ শিক্ষিত না হলেও ছোট ভাইটাকে সে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে চায়। এ জন্য সে একটু একটু করে পয়সা জমা করে। আবার বাড়তি আয়ের চেষ্টা করে। সৈয়দ বাড়িতে সন্ধায় রাবু এবঙ আরিফা দুই বোনকে পড়িয়ে মাসে দশ টাকা আয় করে।
সেকেন্দার মাস্টার একজন সৎ মানুষ। সবাই তাকে এ কারণে পছন্দ করে। সমস্ত মানবিক গুণাবলি সেকেন্দার মাস্টারের মধ্যে ছিল। সেকেন্দার মাস্টার একদিকে যেমন বিনয়ী অন্যদিকে তেমনই বিশ্বস্থ, তালতলি গ্রামের সবাই তাকে ভালোবাসে। এমনকি সৈয়দ বাড়ির বড় গিন্নি যখন কোলকাতায় যায়, তখন সহায় সম্পত্তির দেখাশোনার দায়িত্ব সেকেন্দার মাস্টারের উপর দিয়ে যায়। আরিফা এবং জাহেদের মা এ বাড়ির বড় গিন্নি। সে আপন ভাই ফেলু মিঞাকে বিশ্বাস করে নি। কিন্তু সেকেন্দার মাস্টারকে বিশ্বাস করেছে। শুধু বড় গিন্নি নয়, গ্রামের প্রজারাও তাকে খুব পছন্দ করে। তারা বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে সব সময় সেকেন্দার মাস্টারের কাছে আসে। মাস্টারও তাদেরকে যতটুকু সম্ভব, সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। এভাবেই সেকেন্দার মাস্টারের সাথে প্রজাদের মানবিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। যখন প্রজারা খাজনা দিতে পারে না, তখন সেকেন্দার মাস্টার প্রজার খাজনা মওকুফের জন্য ফেলু মিঞার কাছে আবেদন করে।
সেকেন্দার মাস্টার একজন সাদামনের মানুষ। অতশত মারপেজ সে বোঝে না। সে সহজ-সরল মনে সব কাজ করে। সৈয়দ বাড়ির গিন্নিসহ গ্রামের সবাই সেকেন্দার মাস্টারে কাছে আসে। আর এ কারণেই ফেলু মিঞার এবং রমযানের সাথে সেকেন্দার মাস্টার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত এ দ্বন্দ্বের ফলে থানা পর্যন্ত মামলা গড়ায়। ফেলু মিঞা সবচেয়ে বেশি কৌশলী ও চালাক চরিত্র। সে রমযানের পক্ষ হয়ে আগেই থানায় মামলা করে। পুলিশ সেকেন্দার মাস্টারকে ধরতে গ্রামে আসে। মাস্টার এ সব ঘটনার কোন কিছুই বুঝে উঠতে পারে নি। পুলিশকে দেখে মাস্টারের বুড়ো মা কেঁদে ফেলে। তখন ক্ষমা চাওয়ার শর্তে ফেলু মিঞা মাস্টারকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে সম্মত হয়। সেকেন্দার মাস্টারের সাথে রমযানের দ্বন্দ্ব ক্রমেই বাড়তে থাকে। সেকেন্দার মাস্টার বুঝতে পারে যে, পৃথিবীটা সহজ জায়গা নয়। এখানে ভালো মানুষ টিকে থাকতে পারে না। রমযানের মতো অসৎ ও ভ- মানুষেরাই এ সমাজে মানানসই।
সেকেন্দার মাস্টার জাহেদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে থাকে। তবে জাহেদের সঙ্গে আদর্শের কোন মিল নেই। তবু জাহেদ এই সমাজের একজন ভালো মানুষ। রাজনৈতিক মতাদর্শ আলাদা কিন্তু অন্য বিষয়গুলোতো মিলেমিশে কাজ করতে পারে। এর মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। সেকেন্দার মাস্টার আর ছোট ভাই সুলতানকে নিজের আদর্শে ধরে রাখতে পারে নি। সুলতান রাতারাতি সম্পদের মালিক হওযার স্বপ্ন দেখে। আর তাই সুলতান রমযানের সাথে হাত মেলায়। তারা দু’জন মিলেমিশে একত্রে অপরের সম্পদ লুট করে। এর মধ্যেই বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটে। ভারত-পাকিস্তান নামে নতুন দেশের সৃষ্টি হয়। রমযানের আর সুবিধা হয়। দ্রুত তার সম্পদ ও ক্ষমতা বাড়তে থাকে। এ সময় সেকেন্দার মাস্টার রাজনৈতিক কলাকৌশলে রমযানের কাছে হেরে যায়। তবু সেকেন্দার হাল ছাড়ে নি। রমযান শ্যামাচরণ দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে নিজের নামে ‘কাজী রমযান হাইস্কুল’ রাখতে চেয়েছে। সেকেন্দার মাস্টার এর বিরোধীতা করেছে। জাহেদকে পুলিশ হঠাৎ বন্দি করলে সেকেন্দার মাস্টার রাবুদের স্কুলে যোগদান করতে চেয়েছে। এভাবে দেখা যায় যে, সেকেন্দার মাস্টারের উপর অনেক সময় অনেক ঝড় বয়ে গেছে। তবুও সেকেন্দার মাস্টার ঝড়ে ভেঙ্গে পড়ে নি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সত্য, সুন্দর আর মানবতার কল্যাণের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে। সবকিছ মিলিয়ে ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসে সেকেন্দার মাস্টার এক অসাধারণ পুরুষ চরিত্র। মানবতার সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করা সেকেন্দার মাস্টার চরিত্রের বিশেষ দিক।
উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, এ উপন্যাসের অন্যতম পুরুষ চরিত্র হলো সেকেন্দার মাস্টার। এই চরিত্রে সব ধরনের ইতিবাচক ও মানবিক গুণ আমরা দেখেছি। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক দিক হলো এ চরিত্রের সংগ্রামশীলতা ও সরব প্রতিবাদী চেতনা। সেকেন্দার মাস্টার রমযানের কুটকৌশলে হেরে গেলেও নিজের আদর্শ ও নীতিবোধ থেকে সরে আসে নি। গ্রামে সবশেষে মানবতার কল্যাণে সেকেন্দার মাস্টার নিজেকে নিয়োজিত করে। সে অবশিষ্ট জীবনটুকু মানবকল্যাণে উৎসর্গ করে। এ রকম চরিত্র শুধু শরৎসাহিত্য নয়, সমগ্র বাংলা কথাসাহিত্যেই বিরল। উপন্যাসের প্রথম দিকে সেকেন্দার মাস্টার চরিত্র নিষ্প্রভ মনে হলেও শেষে এ চরিত্র চাঁদের মতো মিষ্টি আলো ছড়িয়ে। শহীদুল্লাহ কায়সারের অসাধারণ সৃষ্টি হলো সেকেন্দার মাস্টার চরিত্র।
সেকেন্দার মাস্টার চরিত্র