ছন্দ কী ? বিভিন্ন প্রকার ছন্দের বৈশিষ্ট্য, প্রকারভেদ, প্রয়োজনীয়তা ও পার্থক্য আলোচনা কর। 231

অনার্স ৩য় বর্ষ

ছন্দ কী? বিভিন্ন প্রকার ছন্দের বৈশিষ্ট্য, প্রকারভেদ, প্রয়োজনীয়তা ও পার্থক্য আলোচনা কর।

সংস্কৃত ভাষায় ‘ছন্দ’ শব্দের এক অর্থ ‘কাব্যের মাত্রা’, আর এক অর্থ ‘ইচ্ছা’ তাই, ‘মাত্রা নিয়মের যে বিচিত্র্যতায় কাব্যের ইচ্ছাটি বিশেষভাবে ধ্বনি-রুপময় হয়ে ওঠে, তাকেই ছন্দ বলে।’
‘ছন্দ’ শব্দের ব্যাপক অর্থ ‘গতি-সৌন্দর্য। ছন্দের সংজ্ঞা প্রদান সম্পর্কে ছান্দসিকেরা বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। ছান্দসিক অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘যেভাবে পদবিন্যাস করিলে বাক্য শ্রুতিমধুর হয়, এবং মনে রসের সঞ্চার হয়, তাহাকে ছন্দ বলে।’
তারাপদ ভট্টাচার্যের মতে, ‘ভাষার অন্তর্গত প্রবহমান ধ্বনি-সৌন্দর্যই ছন্দ।’
বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘বাক্যস্থিত পদগুলিকে যেভাবে সাজাইলে বাক্যটি শ্রুতিমধুর হয় এবং তাহার মধ্যে একটা কৌশলগত ও ধ্বনিগত সুষমা উপলব্ধ হয়, পদ সাজাইবার সেই পদ্ধতিকেই ছন্দ বলে।’
উল্লিখিত সংজ্ঞার মধ্যে ড. সুনীতিকুমারের সংজ্ঞাতে ছন্দের প্রায় সব বৈশিষ্টই পাওয়া যায়।

ছন্দের প্রয়োজনীয়তা :
আমাদের মনে রস আস্বাদনের যে অনুভূতি তাকে পরিবৃত্ত করবার জন্য ছন্দের প্রয়োজন হয়। ছন্দস্পন্দনকে আয়ত্ত করে রস যতটা গাঢ় হয়ে উঠতে পারে, ছন্দস্পন্দনহীন কবিতার রস ততটা গাঢ় হয় না। ছন্দের প্রয়োজন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের স্মরণযোগ্য উক্তি -‘ছন্দের বাহনযোগে কথা কেবল যে দ্রুত আমাদের চিত্তে প্রবেশ করে তা নয়; তার স্পন্দনে নিজের স্পন্দন যোগ করে দেয়।’
যেহেতু সংস্কৃতের ন্যায় হ্রস্ব-দীর্ঘ উচ্চারণ দ্বারা ভাষাকে গম্ভীর করার উপায় নেই; তাই বাঙালি মাত্রেই ভাষার উচ্ছ্বাসের প্রতি যে একটা স্বাভাবিক প্রবণতা আছে, তাকে ছন্দের সংযমে বাঁধতে পারলেই এর ব্যঞ্জনাশক্তি বৃদ্ধি পায়। এই বিশেষ পরিমাণগত পদস্থাপনের পদ্ধতি কবির বক্তব্যকে ব্যঞ্জনাময় করে বলেই বাংলা কবিতায় ছন্দের আবশ্যকতা একান্ত অপরিসীম।

ছন্দের শ্রেণিবিভাগ : বাংলা কবিতার ছন্দকে প্রধানত তিনভাগে ভাগ করা যায়। যথা-১. স্বরবৃত্ত ছন্দ ২. মাত্রাবৃত্ত ছন্দ ৩. অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। নি¤েœ এ তিন প্রকার ছন্দের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো-

স্বরবৃত্ত ছন্দ : যে ছন্দে যুগ্মধ্বনি সব সময় একমাত্রা গণনা করা হয় এবং প্রত্যেক পর্বের প্রথম শব্দের আদিতে শ্বাসাঘাত পড়ে তাকে স্বরবৃত্ত ছন্দ বলে। সাধারণত এ ছন্দে চরণের প্রতি পর্বে চার মাত্রা ও দুই পর্বাঙ্ক থাকে।

স্বরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য :

১.স্বরবৃত্ত ছন্দে যে কোন অক্ষর একমাত্রার।
২. প্রত্যেক পর্বে কমপক্ষে একটি করে যুগ্মধ্বনির অবস্থান থাকে।
৩. চার মাত্রার পর্বভাগই এ ছন্দের আসল কথা।
৪. স্ববৃত্ত ছন্দের প্রত্যেক চরণের প্রত্যেক পর্বে প্রথমে একটি করে প্রবল শ্বাসাঘাত পড়ে।
৫. এ ছন্দে পূর্বের অক্ষরের স্বর কোনটাই দীর্ঘ নয়, সবগুলোই হ্রস্ব, যৌগিক স্বরান্ত অক্ষর পর্যন্ত হ্রস্ব।
৬. এতে যুক্তব্যঞ্জনের পূর্ববতী স্বর সংশ্রিষ্ট উচ্চারণে একমাত্রার।
৭. এর ভাব লঘু চপল
৮. এ ছন্দের লয দ্রুত।
৯. এতে প্রবল শ্বাসাঘাত যুগ্ম-ধ্বনির প্রভাবে একপ্রকার ধ্বনি-তরঙ্গের সৃষ্টি হয়।

মাত্রাবৃত্ত ছন্দ : যে ছন্দে বদ্ধাক্ষর সর্বত্রই দুই মাত্রা হিসেবে বিবেচিত হয়, তাকে মাত্রাবৃত্ত ছন্দ বলে।

মাত্রাবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য :

১. মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রুদ্ধদল সর্বদাই বিশ্লিষ্ট উচ্চারণে দুই মাত্রার হয়।
২.এ ছন্দে উচ্চারিত অক্ষর-ধ্বনি থেকেই মাত্রারীতি স্থিরীকৃত হয়।
৩. এ ছন্দে কেবল স্বরান্ত অক্ষর দ্বারাই পর্ব সংঘটিত হয়।
৪. এ ছন্দে সাধুভাষা বা সাধুরীতির ব্যবহার বেশি।
৫. এ ছন্দে শব্দ-ধ্বনির প্রাধান্য বেশি
৬. এ ছন্দে স্বরবৃত্তের মতো ধ্বনি সংকোচ নেই; আছে ধ্বনিবিস্তার
৭. এ ছন্দের মূল পর্ব চার, পাঁচ, ছয়, সাত, এবং আট মাত্রার। তবে এ ছন্দে ছয় মাত্রার চালই বেশি।
৮. এ ছন্দের লয় বিলম্বিত, গতিবেগ ঢালাসুরে একটানা প্রবাহিত।
৯. এর ভাব ললিত মধুর
১০. এ ছন্দের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এর গীতিপ্রবণতা বা সুরনিষ্ঠতা।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দ : যে ছন্দের আদিতে ও মধ্যে যুগ্মধ্বনি থাকলে তা সংশ্লিষ্ট উচ্চারণে একমাত্রা এবং শেষে যুগ্মধ্বনি থাকলে বিশ্লিষ্ট উচ্চারণে দুই মাত্রা ধরা হয়, সে ছন্দকে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বলে।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য :

১.অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মূল পর্ব দুটি-আট ও ছয় মাত্রার।
২. এ ছন্দে শব্দের আদি ও মধ্যের যুগ্মধ্বনি ঠাসা বা সংশ্রিষ্ট উচ্চারণে একমাত্রার এবং শেষের যুগ্মধ্বনি বিশ্লিষ্ট উচ্চারণে দুই মাত্রার।
৩.এ ছন্দে সাধুভাষার ব্যবহার বেশি।
৪.এ ছন্দে লয় ধীর বা মধ্যম।
৫.এ ছন্দে চরণস্থ পর্বসমূহে অক্ষর ধ্বনিকে আচ্ছন্ন করে একটা অতিরিক্ত সুরের তান নিয়ত প্রবাহমান।
৬.এ ছন্দ যেহেতু অক্ষর সর্বস্ব; তাই এর অক্ষর গুণে মাত্রা ঠিক করলেই চলে।
৭.এ ছন্দে আদি ও মধ্যের যুগ্মধ্বনি বা বদ্ধাক্ষর চার জায়গায় দ্বিমাত্রিক।
৮.এ ছন্দে তানের প্রবাহে এর অন্তর্গত যুক্ত ব্যঞ্জনের মাত্রা সংকুচিত হয়ে একমাত্রা হয়।
৯.এ ছন্দের ভাব ও ভাষা গভীর, গম্ভীর, বিপুল এবং বিশাল।
১০.এ ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর সাধারণ শোষণশক্তি যার ফলে যুক্তাক্ষরবিহীন পর্বকে যুক্তাক্ষরবহুল করলেও এর মাত্রা সংখ্যার কোন তারতম্য হয় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *