ভ্রমণকাহিনি হিসেবে দেশে বিদেশে কতটুকু সফল-আলোচনা কর। 231005

ভ্রমণকাহিনি হিসেবে দেশে বিদেশে কতটুকু সফল-আলোচনা কর।

সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৫-১৯৭৪) বাংলা সাহিত্যের একজন খ্যাতিমান রম্যলেখক। তিনি ‘সুরসিক সাহিত্যিক’ হিসেবে নিজের আসনটি বাংলা সাহিত্যে পাকাপক্ত করেছেন। জীবনের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর লেখার উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘দেশে বিদেশে’ তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য রম্যরচনা। তিনি আফগানিস্তানে অবস্থানকালে যে সব বিষয় দেখেছেন, তারই বিবরণ ‘দেশে বিদেশে’ গ্রন্থে সৈয়দ মুজতবা আলী উল্লেখ করেছেন। সে দেশের নানা রকম সামাজিক, সাংস্কৃতিক চিত্র, প্রথা, রীতি-নীতি, বিধি-বিধান এমনকি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়টিও তিনি লক্ষ্য করেছেন। আর এ সবই তুলে ধরেছেন ‘দেশে বিদেশে’ গ্রন্থে। নিম্নে ভ্রমণকাহিনি হিসেবে ‘দেশে বিদেশে’ গ্রন্থের সফলতা আলোচনা করা হলো-

সৈয়দ মুজতবা আলী একজন সচেতন শিল্পী। তিনি দীর্ঘদিন আফগাস্তিনে অবস্থান করেছেন। সে দেশের নানা রকম বিষয় দেখেছেন। এই অভিজ্ঞতা দিয়েই ‘দেশে বিদেশে’ নামে একটি ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন। সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা হলো : আব্দুর রহমান লেখকের আফগাস্তিানে বসবাসকালীন সময়ের সুখ-দুঃখের সাথী। আব্দুর রহমান চরিত্রটি লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর নানা রকম কাজের দায়িতে নিয়োজিত্ব। তবুও এ চরিত্রটিতে বিভিন্ন মাববিক গুণের সমাহার থাকায় সে লেখকের বন্ধু হয়ে উঠছে। তাই আব্দুর রহমান চরিত্রটি লেখকের বন্ধু, সচিব, সংবাদদাতা এবং কাবুল সংক্রান্ত নানা তথ্যের বিশ্লেষক। আব্দুর রহমান আফগানিস্তানের ‘দেরশি’ নামক পোষাক পরিধান করে লেখকের সামনে হাজির হয়। পায়ে নাগরাই, চোখে হাসি, মুখে খুশি নিয়ে সব সময় প্রস্তুত। সমাজ সংস্কারের কারণে যখন সমগ্র আফগান প্রকম্বিত, জালালাবাদ শিনওয়ারীদের কবলে, প্রচুর বরফপাতের ফলে যখন বাইরের সাথে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন-তখন আব্দুর রহমানই লেখকের একমাত্র নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। আব্দুর রহমান নিজের হাতে শুধু রান্না-বান্নাসহ অনান্য প্রয়োজনীয় কাজই সম্পর্ণূ করেনি, বরং একজন দক্ষ পরামর্শদাতার মতো সমযে সময়ে লেখককে পরামর্শ দিয়েছে আর লেখক সে পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করে হাতে হাতে সুফল পেয়েছে।

সৈয়দ মুজতবা আলী ‘দেশে বিদেশে’ গ্রন্থে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পাটভূমি এই গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। আফগানিস্তানের একটি রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। হবীবল্লাহ আফগানিস্তানের আমীর ছিল। এই পরিবারের আমানুল্লাহ কীভাবে মায়ের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে রাজা হয় এবং আমানুল্লাহ এর সমাজ সংস্কারের কারণে দেশের মোল্লা সম্প্রদায় ও বিদ্রোহীরা যৌথভাবে আমানুল্লাহ এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এতে আমানুল্লাহ ক্ষমতা হারায়। এই সমস্ত রাজনৈতিক বিষয়ও তিনি ‘দেশে বিদেশে’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। সৈয়দ মুজতবা আলী এই গ্রন্থে আফগানিস্তানের বিভিন্ন স্থানের প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন। এই বর্ণনাগুলো অপূর্ব। এমনকি তিনি পথের বর্ণনাও দিয়েছেন। এখানে পেশাওয়ার থেকে কাবুল পথের আংশিক বর্ণনা উপস্থপন করতে চাই। দু’দিকে হাজার ফুট উচু পাহাড়ের পথ, মাঝখানে খাইবার পাস। একজোড়া রাস্তা এঁকেবেঁকে একে অন্যের গা ঘেষে কাবুলের পথে চলছে। একটি রাস্তা মোটরের জন্য, অন্যটি উট, খচ্চ্র, গাধা ঘোড়ার জন্য। সংকীর্ণ স্থানে এ রাস্তা মিলেমিশে একাকার হয়ে হয়ে যায় এবং এ রাস্তা আবার মাতালের মতো হেলেদুলে চলেছে, ডানে বাঁয়ে পিছনে তাকালে চোখে পড়ে পাহাড় আর পাহাড়। এমনই কাবুলের রাস্তা। নিমলার বাগানের সৌন্দর্য আমরা চোখে দেখি নাই। কিন্তু ‘দেশে বিদেশে’ গ্রন্থে পাঠ করে আমরা মুগ্ধ হয়ে যাই। লেখক আফগানিস্তানে গেলে একমাত্র পরিচিত হিসেবে পেয়েছিলেন বগদানফকে। এই লোকটি সম্পর্কে তিনি যে বর্ণনা দিয়েছেন তা এক কথায় অসাধারণ। আফগাস্তিানের খাবারের বর্ণনা পড়ে আমরা অবাক হয়ে যাই। এই গ্রন্থে লেখক পানশির নামক জায়গার আবহাওয়ার সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। পানশির এমন একটি জায়গা যেখানে একটি আস্ত দুম্বা খেয়ে এক ঢোক পানি খেলে আবার ক্ষুধা পেয়ে যাবে এমনই পানশিরের আবহাওয়া। পানশিরের মানুষ হেঁটে চলে না, বাতাসের উপর ভর করে উড়ে চলে। সইফুল আলমের ছোট ভাইয়ের বিয়েতে গিয়ে লেখক নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করেন। যখন খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই ঘুমুচ্ছে তখন এক বৃদ্ধা সেতারে আওয়াজ তুলে এভাবে-‘আজি নিশীথে প্রিয়া অধরের চুম্বন যদি পাই জোয়ান হব’। লেখক এ গান শুনলেন, গান বন্ধ, তবুও ভেসে আসছে কানে- একটি রাতের তরে একটি চুম্বন পাই-জোয়ান হব। লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী ‘দেশে বিদেশে’ গ্রন্থে তাঁর অভিজ্ঞতার নানা বিষয় উপস্থাপন করেছেন। আমির আমাউল্লাহর সমাজ সংস্কারের বিষয় তিনি তুলে ধরেছেন। লেখক দেখেছেন যে, আমির আমানউল্লাহ ছেলেদের লেখাপড়ার যাতীয় বিষয় ফ্রি করে দিয়েছেন। যেমন খাতা-কলম, বই-পুস্তক, পোষাক পরিচ্ছেদ, সব সরকার বহন করবে। এরপর হোস্টের থেকে কোন ছেলে পালালে সরকার অদ্ভুত নিয়ম চালু করে। দুইজন সিপাই ছেলের বাড়িতে যাবে, ভালো মন্দ খাবে এবং ছেলেকে না পেলে বাবাকে মার দেবে, তখন বাবা বাধ্য হয়ে ছেলে খুঁজতে বের হবে। ছেলে হোস্টেলে হাজিরা দিলে তবে আসামি ধরা দিয়েছে এই মর্মে লিখবে। তখন সিপাই দুটি ঐ বাড়ির দুটি দুম্বা জবাই করে খেয়ে তারপর অফিসে ফিরবে। এভাবে দেখা যায় যে, লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী যা দেখেছেন তাই তার বর্ণনায় অপূর্ব করে তুলেছেন। তাই সার্বিক বিশ্লেষণে বলা যায় যে, ‘দেশে বিদেশে’ একটি সার্থক ভ্রমণকাহিনি।

সৈয়দ মুজতবা আলী একজন সফল শিল্পী। ভাব প্রকাশের তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে। তিনি আফগানিস্তানের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, জীবনব্যবস্থা, মানুষের নানাবিধ কর্মকাণ্ডের একটি সুন্দর বর্ণনা এ ভ্রমণসাহিত্যে উপস্থাপন করেছেন। বিষয়ের সাথে ভাবের মিল আছে। বক্তেব্যের মাঝে প্রবহমানতা রয়েছে। সমাজের যুবক-যুবতীদের কর্মকাণ্ড, বিবাহিতদের জীবন ব্যবস্থা, এমন কি নাপিতের দোকান, দর্জির দোকানের বর্ণনাও এ ভ্রমণ সাহিত্যে আমরা দেখতে পাই। সৈয়দ মুজতবা আলী নিজের চোখে দেখা বিষয়গুলো অত্যন্ত, সহজ, সুন্দর ভাষায় প্রাসঙ্গিকভাবে তিনি ‘দেশে বিদেশে’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এ গ্রন্থ পাঠ করে আমরা পাঠক সাধারণ মুগ্ধ হয়ে যাই। পাঠকের চোখের সামনে যেন আপগানিস্তানের নানা বিষয় ছবির মতো ভেসে ওঠে। এ সবই মুজতবা আলীর উপস্থাপনার কৃতিত্ব। তাই সার্বিক বিচার বিশ্লেষণে বলা যায় যে, ‘দেশে বিদেশে’ ভ্রমণ সাহিত্য হিসেবে সার্থক ও সফল হয়েছে। এ রকম ভ্রমণ সাহিত্য বাংলা ভাষায় খুব কমই আছে।

সালেক শিবলু এমফিল, গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।

Scroll to Top