কাজী আবদুল ওদুদের সংস্কৃতির কথা প্রবন্ধের আলোকে বাংলা সংস্কৃতির স্বরুপ আলোচনা কর।

সংস্কৃতির কথা
কাজী আবদুল ওদুদের সংস্কৃতির কথা প্রবন্ধের আলোকে বাংলা সংস্কৃতির স্বরুপ আলোচনা কর। অথবা,(সংস্কৃতি কীভাবে সামাজিক হয়ে ওঠে)

প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। উনিশ শতকের প্রথম দিক থেকে প্রবন্ধ সাহিত্যের সূত্রপাত ঘটে। এ সময় থেকেই বিচিত্র বিষয় অবলম্বন করে প্রবন্ধ সাহিত্য গড়ে উঠতে থাকে। যারা প্রবন্ধ সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০) অন্যতম। ‘শাশ্বত বঙ্গ’ তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ গ্রথ। এ গ্রন্থে যে সব প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে, তন্মধ্যে ‘সংস্কৃতি কথা’ একটি অন্যতম প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধে কাজী আবদুল ওদুদ সংস্কৃতির স্বরুপ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তাঁর যুক্তিনিষ্ঠ মতামত শৈল্পিকভাবে তুলে ধরেছেন। নিম্নে প্রবন্ধটির মূল বক্তব্য / সংস্কৃতির স্বরুপ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো –

কাজী আবদুল ওদুদ একজন প্রগতিশীল মনের মানুষ। তিনি ‘সংস্কৃতির কথা’ নামক প্রবন্ধে বাঙালি সংস্কৃতির স্বরুপ সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত মতামত অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। ‘সংস্কৃতি’ আমাদের কাছে একটি পরিচিত বিষয় কিন্তু এর সংজ্ঞা প্রদান অত্যন্ত কঠিন। তাছাড়া সংস্কৃতির সুনিদিষ্ট কোন সংজ্ঞাও নেই। সাধারণভাবে মানুষের জীবন আচরণকে সংস্কৃতি বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন গবেষক ও পণ্ডিতেরা নানা ভাবে সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিয়েছেন। প্রাবন্ধিক কাজী আবদুল ওদুদ সংস্কৃতির একটি ছোট্ট সংজ্ঞা তাঁর ‘সংস্কৃতির কথা’ প্রবন্ধে দিয়েছেন। তার মতে সুন্দরের সাধনাই হলো সংস্কৃতি।

পরিবর্তনশীল এ বিশ্বে মানুষও পরিবর্তনশীল। সব সময় মানুষ পরিবেশ ও প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। এটা মানুষ প্রকৃতি থেকেই শিখে নেয়। ইউরোপ মহাদেশে সংস্কৃতি উনবিংশ শতাব্দীতে প্রবল হয়। এ সময় ইউরোপে বিভিন্ন প্রকারের বিপ্লব ঘটে যায় যেমন শিল্প বিপ্লব, ভাব বিল্পব, অর্থনৈতিক বিপ্লব, রাষ্ট্রিক বিল্পব ইত্যাদি। এই সব বিল্পবের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বিশেষ ধরনের সচেতনতা জাগ্রত হয়। ফলে মানুষ ধর্মকেন্দ্রীক জীবন-যাপন থেকে অনেকটা সরে আসে। সংস্কৃতি এ সময় এ ধর্মের জায়গা অধিকার করে নেয়। ভারববর্ষের সংস্কৃতি ইউরোপ থেকে এসেছে বলে প্রাবন্ধিক মনে করেন। কাজী আবদুল ওদুদ ভারতবর্ষের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দু’জন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছেন। একজন বাংলার সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অপর ব্যক্তি হলেন পাঞ্জাব প্রদেশের উর্দু ভাষার বিখ্যাত কবি ইকবাল। প্রাবন্ধিকের মতে এই দু’জন চিন্তা নায়ক চিন্তার দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তাঁদের জনপ্রিয়তার কারণ তাদের চি›তার গতিশীলতা।

ভদ্রলোক হওয়া বা কোন একটি ভদ্র পরিবার গড়ে তোলা শিক্ষিত ব্যক্তির লক্ষ্য ছিল। কিন্তু এটিতো আর সংস্কৃতি নয়। মানুষ সামাজিক জীব। প্রথমে সে ব্যক্তিগত, তারপর পারিবারিক ও সামাজিক, সবশেষে সে বিশ্বজনিন। এই হলো মানুষের পরিচয়। সংস্কৃতির মূল কথাই হলো উৎকর্ষ সাধন করা। মানুষ সাধারণত ব্যক্তিগত বা পারিবারিক উৎকর্ষ সাধনে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু এ উৎকর্ষ যত সুন্দরই হোক, এর বিশেষ কোন মূল্য নেই। সংস্কৃতির আসল কথাই হলো সামাজিক উৎকর্ষ সাধন করা। সমাজের অর্থ একদিকে বিশ্বমানব সমাজ, অন্যদিকে দেশগত বা রাষ্টগত সমাজ। সে জন্য সংস্কৃতিও মূলত বিশ্বসামাজিক ও রাষ্ট্রিক বিষয়। সংস্কৃতি মানে মানানসই পোষাক-পরিচ্ছেদ নয়, জ্ঞান ও উৎকর্ষ লাভের মাধ্যমে সমস্ত ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে এক বিশেষ ধরনের সমন্বয় সাধন করা।

প্রাবন্ধিক বাংলার মুসলমান সমাজের সংস্কৃতি সম্পর্কে এ প্রবন্ধে তাঁর চিন্তাশীল বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। বাংলার সমাজ বিচিত্র বর্ণের, বিচিত্র ধর্মের, বিচিত্র মানুষের সমন্বয়ে গঠিত। এর মধ্যে আছে হিন্দু, বৌদ্ধ, পাঠান আর আরব। কিছুকাল পূর্বেও মুসলমান সমাজ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। একদিকে আশরাফ, অন্যদিকে আতরাফ। এই দুই শ্রেণির মধ্যে কোন রকম সামাজিক আদান-প্রদান প্রায় হতো না, অনেকটা হিন্দু জাতির বর্ণপ্রথার মতো বলে প্রাবন্ধিক মনে করেন। শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে ভারতবর্ষে এমন বিচিত্র মত ও বিচিত্র পথ এ দেশে স্থান পেয়েছিল। তখন অনেকেই লীলাবাদে বিশ্বাসী ছিল। সব কিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিতো। তারপর এক সময় ইউরোপের ছোঁয়া পেয়ে ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান এই দুই সমাজের মধ্যে আত্ম-অন্নেষণ প্রক্রিয়া জেগে উঠল। ফলে সমাজে ইতবাচক পরিবর্তন হলো। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক মহিমাময় ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটলো।

প্রাবন্ধিক নানা সমস্যায় মুসলমান সমাজকে জর্জরিত দেখেছেন। আর্থিক দৈন্যের চেয়ে ভাবের দৈন্যই বেশি। মুসলমানদের মধ্যে সংকল্পের দৈন্যও দেখেছেন। ইসলামের জীবন মানেই জ্ঞানের জীবন, ইসলামের জীবন মানেই প্রেমের জীবন। জ্ঞান আর প্রেমের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া-এই কেবল ইসলামের অর্থ হতে পারে বলে প্রাবন্ধিক মনে করেন। আজকের বড় কথা হলো মানবজাতির প্রাণশক্তির সন্ধান করা, যা থেকে সম্ভব হবে জাতিতে জাতিতে অথবা সমাজে সমাজে সহযোগিতা বাড়ানো যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে মঙ্গলের পথ প্রশস্ত হবে।

উপর্যুক্ত আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, কাজী আবদুল ওদুদ একজন প্রগতিশীল মনের মানুষ। তিনি ‘সংস্কৃতির কথা’ নামক প্রবন্ধে বাংলার সংস্কৃতি সম্পর্কে তার চিন্তাশীল মনের পরিচয় দিয়েছেন। সংস্কৃতি মানে সুন্দর ও কল্যাণের সাধনা করা এবং সমাজ, দেশ ও জাতির মঙ্গল সাধনে সচেতন থাকা। সংস্কৃতি মানে জ্ঞান অর্জন করা, প্রেমবান হওয়া, সমন্বয় সাধন তরা, সচেতন হওয়া। বিষয়বস্তু নির্বাচন, উপস্থাপনাশৈলি, মননশীল চিন্তা-চেতনায় ‘সংস্কৃতির কথা’ একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রবন্ধ।

সালেক শিবলু এমফিল, গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *