সেন বংশের ইতিহাস সংক্ষেপে লেখ। 211001

সেন বংশের ইতিহাস

সেন বংশের ইতিহাস সংক্ষেপে লেখ।

উপস্থাপনা : বাংলায় সামন্তচক্রের বিদ্রোহে পালসম্রাজ্যের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে সেনবংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। একাদশ শতাব্দীর মধ্যখানে সামন্তসেন ও তার পুত্র হেমন্তসেন কাশিপুর নামক স্থানে এক ক্ষুদ্র রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার ইতিহাসে সেন রাজাগণই সর্বপ্রথম সমগ্র বাংলায় এক স্বাধীন রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তাই ইতিহাসে সেন বংশের শাসনামল অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ।
সেন বংশের পরিচয় : সেন লিপিমালা হতে জানা যায়, সেন রাজাগণ ছিলেন চন্দ্রবংশীয় এবং ব্রহ্মক্ষত্রিয়। ব্রহ্মক্ষত্রীয় সেনপরিবারের পূর্বপুরুষগণ ব্রাহ্মণ ছিলেন, পরে ব্রাহ্মণবৃত্তি পরিত্যাগ করে হ্মত্রীয়বৃত্তি গ্রহণ করেন। সেনরাজাগণের পূর্বপুরুষ দাক্ষিণাত্যের অর্ন্তগত কর্ণাটকদেশের অধীবাসী ছিলেন।
বাংলায় আগমন : সেন রাজরা বাংলায় কোন সময় কিভাবে আগমন করেছিলেন- এ বিষয়ে বিস্তারিত ইতিহাস সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে অনেকে মনে করেন যে, কর্ণাটক দেশের এক সেনবংশ বহুদিন যাবৎ রাঢ় দেশে বাস করত। এইবংশের সামন্তসেন কর্ণাটকদেশে বহু যুদ্ধবিগ্রহে খ্যাতি অর্জন করেন। এবং ভবিষ্যৎ উন্নতির সোপান রচনা করেন। তার পুত্র হেমন্তসেন পাল বংশের রাজত্বকালেই বাংলায় রাজক্ষমতার ভিত্তি স্থাপন করেন।

রাজক্ষমতা প্রতিষ্ঠা : কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন, সেন রাজারা প্রথমে পাল রাজাদের অধীনে উচ্চ রাজপদে চাকরি করতেন। পরে পালরাজাদের দুর্বলতার সুযোগে তারা স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। আবার কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন, দাক্ষিণাত্যের চালুক্যরাজ্য ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য ও তৃতীয় সোমেশ্বরের আমলে চালুক্য বাহিনির সঙ্গে সেন বংশ বাংলায় আসেন। তারপর বাংলায় বসতিস্থাপন করে ধীরে ধীরে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন।

সামন্ত সেন ও হেমন্তসেন : সেনবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সামন্তসেন। তিনি রাঢ় অঞ্চলে বসবাস করতেন। তার কোন রাজউপাধি ছিল না। তার পুত্র হেমন্তসেন প্রথমে ‘মহারাজাধিরাজ” উপাধি পান। সম্ভবত তিনি রামপালের অধীনে একজন সামন্ত রাজা ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে হেমন্তসেনের পুত্র বিজয়সেনই সামন্তরাজ্য হতে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সফলকাম হয়েছিলেন।

বিজয়সেন (১০৯৮-১১৬০) : বিজয়সেন পাল আধিপত্য উচ্ছেদ করেন। বিক্রমপুর তাম্রশাসন ও দেওপাড়া লিপি হতে জানা যায়, তিনি মুর বংশীয় এক রাজকন্যাকে বিবাহ করেন এবং উড়িষ্যারাজ চন্দন বর্মন চোড়গঙ্গের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে নিজ শক্তি বাড়ান। তিনি বর্মদের নিকট হতে পূর্ববঙ্গ এবং পালদের নিকট হতে উত্তরবঙ্গ জয় করেন। এক সময়ে সমগ্র বাংলাদেশে বিজয়সেনের প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

বললালসেন (১১৬০-১১৭৮) : বিজয়সেনের পর তার পুত্র বললালসেন সিংহাসনে আরোহণ করেন। বললালসেন রচিত ‘দানসাগর’ ও অদ্ভুত সাগর’ নামক গ্রন্থ হতে তার রাজত্বের বিবরণ পাওয়া যায়। বললালসেন সম্পূর্ণরুপে পাল বংশের অবসান ঘটিয়ে সমগ্র বাংলাদেশে সেন বংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার রাজ্যসীমা পশ্চিমে মগধ ও মিথিলা হতে পূর্ব পর্যন্ত ও উত্তরে দিনাজপুর , রংপুর ও বগুড়া হতে দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বললালসেনের এ রাজ্য পাঁচটি অংশে বিভক্ত ছিল। এগুলো হলো- রাঢ়, বরেন্দ্রী, বঙ্গ, বাগড়ী ও মিথিলা। বললালসেন একজন খ্যাতনামা সমাজ সংস্কারক ছিলেন। সমাজে তিনি কৌলিন্য প্রথা পপ্রচলন করেছিলেন

লক্ষণসেন (১১৭৮-১২০৫) : লক্ষণসেন সমগ্র বাংলায় তার আধিপত্য প্রতিষঠা করেন। তার উপাধি ছিল ‘গৌড়েশ্বর’। রাজত্বের প্রথমদিকে তিনি যথেষ্ঠ সামরিক প্রতিভার পরিচয় দেন। কিন্তু তার রাজত্বের শেষ দিকে সেন সাম্রাজ্য ক্রমেই দুর্বল হতে থাকে। অবশেষে দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে অথবা ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি অতর্কিতভাবে লক্ষণসেনের রাজধানী নদীয়া আক্রমন করেন। লক্ষণসেন আক্রমন প্রতিহত করতে না পেরে পূর্ববঙ্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

সেন বংশের পতন : লক্ষণসেনের রাজত্বকালে মুসলিম আক্রমনের পরে সেন সম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। লক্ষণসেনের মৃত্যুর পরে তার দুই পুত্র বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গে কিছুদিন রাজত্ব করলেও পিতার রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হননি। মুসলিম আক্রমন ছাড়াও সেন বংশের অর্ন্তবিদ্রোহ এ বংশের পতনের অন্যতম কারণ। সেনদের দুর্বলতার সুযোগে দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব হয়।

সেন বংশের গুরুত: বাংলার ইতিহাসে সেনবংশ একটি গুরুত্বর্পূূ অধ্যায়। পালবংশের পতনের পর সেনরাজাদের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিভার গুণে বাংলায় পুনরায় একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের প্রচেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দুধর্ম বাংলায় সুপ্রতিষ্ঠত হয় এবং সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি সাধিত হয়।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।

About সালেক শিবলু

বিএ অনার্স, এমএ (প্রথম শ্রেণি) এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

View all posts by সালেক শিবলু