চর্যাপদের রচনাকাল নির্ণয় কর। (কে কখন কোথায় আবিষ্কার করেন / গুরুত্ব/ তাৎপর্য)
‘চর্যাপদ’ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবার থেকে এ পদ আবিষ্কার করেন। তারপর ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ‘হাজার বছরের পুরাণ বাংলা ভাষার বৌদ্ধ গান ও দোহা’ নামে প্রকাশিত হয়। ‘চর্যাপদ’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এর রচনাকাল নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। লেখকগণ চর্যাপদের রচনার কোন কাল উল্লেখ করেন নি। তারা ধর্মীয় উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এ সব পদ রচনা করেছেন। তাই এর রচনাকাল সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় নি। তবুও প-িতেরা চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং নানা রকম মতামত প্রদান করেছেন। সে সব মতামতের ভিত্তিতে নিম্নে চর্যাপদের রচনাকাল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
চর্যাপদের আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সিদ্ধাচার্য লুইপাদের সময় ১১শ শতকের প্রথম ভাগ বলে মন্তব্য করেছেন। লুইপা চর্যাপদ রচনার প্রথম কবি বলে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মনে করেছেন। সুতরাং ‘চর্যাপদ’ রচনাকালের প্রাথমিক সময়সীমা একাদশ শতক। ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় চর্যাপদের রচনাকাল ১০ম থেকে ১২শ শতক বলে অনুমান করেন। তাঁর এই মতকে সমর্থন করেন আরেকজন গবেষক প্রবোধচন্দ্র বাগচী। ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কাহ্নপাদের আবির্ভাবকাল ১২শ শতক বলে অভিমত দেন। তাঁর মতে চর্যাপদের রচনাকাল ১০ম থেকে ১২শ শতকের মধ্যে। ডক্টর সুকুমার সেন ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতামতকে সমর্থন করেন। অর্থাৎ চর্যাপদের রচনাকাল দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে।
গোপাল হালদার ‘বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা’ গ্রন্থে চর্যাপদের রচনাকাল সম্পর্কে বলেন-‘চর্যাপদের মূলপুঁথিখানি ১৪ শতকের। পুঁথিখানি এত পুরাতন না হলেও এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে চর্যাগুলো বেশ প্রাচীন। সঠিককাল অবশ্য প্রায় কোনো প্রাচীন বা মধ্যযুগের বাঙলা কাব্যেরই বলা যায় না। চর্যার রচনাকালও সেরূপ সুনিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনে করেন তা খ্রিষ্টিয় ৭ম শতকের লেখা। কিন্তু অধিকাংশ চর্যাগুলো এত প্রাচীন নয়-রচনাকাল সম্ভবত খ্রিস্টিয় ৯৫০ হতে ১২০০অব্দের মধ্যে।’
বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ও গবেষক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁর মতে চর্যাপদের রচনার প্রাথমিককাল সপ্তম শতকের মধ্যভাগ বলে মনে করা যায়। তিনি বলেন, ‘মীননাথ বা মৎসেন্দ্রনাথ যে নাথ পন্থার আদি গুরু এবং প্রবর্তক এবং বাংলা ভাষার প্রাচীন লেখক, তা অনেকেই স্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু তাহার সময় সমন্ধে ভিন্নমত আছে।’
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর মতে চর্যাপদের আদি কবি শবরপা, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে লুইপা। শবরপা ছিলেন লুইপার গুরু। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শবরপাকে সপ্তম শতকের কবি বলে মনে করেন। তাঁর মতে, শবরপার জীবনকাল ৬৮০ থেকে ৭৬০ খ্রিস্টাব্দ। শবরপা বাংলাদেশের লোক ছিলেন। লুইপা বাংলাদেশের গঙ্গার ধারে বাস করতেন বলে এক তিব্বতী ঐতিহাসিক মতামত দিয়েছেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লুইপাদের সময় ৭৩০ থেকে ৮১০ খ্রিস্টাব্দ বলে মনে করেন।
চর্যাপদের রচনাকাল সম্পর্কে প-িতেরা এভাবে নানা মত দিয়েছেন। এই আলোচনায় একটি বিষয় স্পষ্ট যে, এ পদগুলো ১২শতকের রচনা।এ পদগুলো পাল আমলে রচিত হয়েছে-এ বিষয়ে কোন মতভেদ নেই। বাংলাদেশে পালেরা দীর্ঘকাল প্রায় চারশত বছর রাজত্ব করেছে। তারা বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। এ পদগুলোতে বৌদ্ধ ধর্মের সাধনপ্রণালী সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং এগুলো ৬৫০ থেকে ১২০০ সালের মধ্যে রচিত বলে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যে মতামত দিয়েছেন- এর সাথে একমত পোষণ করা যায় এবং এর যৌক্তিকতাও আছে। ডক্টর সুকুমার সেন চর্যাপদের প্রাচীনত্ব স্বীকার করে নিয়েও চার-পাঁচশত বছর এর ব্যাপ্তিকাল সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি দশম থেকে ১২ শতকের মধ্যে এ পদগুলো রচিত বলে মনে করেন।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যাপদের ভাষাকে বাংলা ভাষার আদিরুপ বলে স্বীকার করেছেন এবং তা অবশ্যই সাহিত্যিক ভাষা এবং এ গ্রন্থটির সাহিত্যিক মূল্যও এককথায় অসাধারণ। তিনি ডক্টর সুকুমার সেনের আপত্তিকে খ-ন করেছেন এভাবে- ‘সাহিত্যিক ভাষার এইরুপ অবিকৃত থাকাই নিয়ম। সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ তাহার দৃষ্টান্ত। প্রাচীন বাংলাও তাহার ব্যতিক্রম নহে।’
‘চর্যাপদ’ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন কবিতার সংকলন গ্রন্থ। এ গ্রন্থটি হাজার বছরের ঐতিহ্য। নানা কারণে এ গ্রন্থটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। এ গ্রন্থের মাধ্যমে আমরা প্রাচীন মানুষের জীবনদর্শন, সমাজচিত্র, পারিবারিক চিত্র, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দর্শন সম্পর্কে জানতে পারি। অতীত ইতিহাস সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক তথ্যের অভাবে এ গ্রন্থটির সঠিক রচনাকাল নিয়ে এখনও গবেষকরা একমত হতে পারেন নি। তবে উপর্যুক্ত আলোচনা, পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যায় যে, বিশিষ্ট গবেষক ও ভাষাবিজ্ঞানী ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যাপদের রচনাকাল সম্পর্কে যে মতামত দিয়েছেন তা অধিক যুক্তিযুক্ত ও প্রাসঙ্গিক। তাই তাঁর মতামত মেনে নিয়ে বলা যায় যে, বাংলা ভাষার সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ চর্যাপদের রচনাকাল ৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।