রম্য রচনার পথিকৃৎ হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান আলোচনা কর।
‘সাহিত্য সম্রাট’ উপাধিতে ভূষিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। প্রথম সার্থক উপন্যাসের স্রষ্টা হিসেবে তিনি সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। উপন্যাসের মতো তিনি প্রবন্ধ সাহিত্যেও সসফলতার পরিচয় রেখেছেন। তাঁর রচিত হাস্যরসাত্মক ও ব্যঙ্গধর্মী রচনাগুলো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন। তিনি ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, ভাষা ও সমাজ বিষয়ক বহু প্রবন্ধ রচনা করেছেন। ‘সাম্য’, ‘কৃষ্ণচরিত্র’, ‘লোকরহস্য’, ‘বিজ্ঞানরহস্য’, ‘বিবিধ প্রবন্ধ’, ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ ইত্যাদি তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ। এরমধ্যে ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ বঙ্কিমের এক বিশিষ্ট রচনা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে বিরাট প্রতিভা নিয়ে আবির্ভূত হোন। বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, সমাজতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয় তাঁর প্রবন্ধে স্থান পেয়েছে। তাঁর প্রবন্ধগুলোকে কয়েকটিভাগে ভাগ করা যায়। তন্মধ্যে ব্যাঙ্গাত্বক ও সরস রচনা যেমন : লোকরহস্য, কমলাকান্তের দপ্তর, মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত ইত্যাদি অন্যতম। নিম্নে রম্য রচনার পথিকৃৎ হিসেবে বঙ্কিমের অবদান আলোচনা করা হলো-
কমলাকান্তের দপ্তর বঙ্কিমচন্দ্রের বিশিষ্ট ব্যাঙ্গাত্বক রচনা। কমলাকান্ত চক্রবর্তী নামক এক কাল্পনিক আফিমখোরের উক্তির মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর পারিপার্শি¦ক অবস্থা ব্যাঙ্গাত্বক ভাষার মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। পুস্তকারে এ প্রবন্ধগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৮৭৫ সালে। বঙ্কিমচন্দ্রের নিজস্ব পত্রিকা ‘বঙ্গগদর্শন’এ এ প্রবন্ধগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
বঙ্কিমচন্দ্র একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ছিলেন। তিনি সমাজ ও দেশকে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন। এই দেশ তখন বৃটেনের অধীনে ছিল। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত ছিল এ দেশ। আর কিছু দালাল, চাটুকারের দ্বারা এ দেশটা ভরে যায়। সামন্ত ও সাম্রাজ্যবাদীদের নিষ্পেষণে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। এই সমস্ত বিষয়ই বঙ্কিম সরাসরি প্রবন্ধে না বলে একটু ঘুরিয়ে বর্ণনা করেছেন। রচনা উপস্থাপনের মধ্যে রয়েছে হাসি-তামাশার মিশ্রণ। তাই এগুলোকে রম্য রচনা বলা হয়ে থাকে। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ প্রবন্ধগ্রন্থ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, রম্যরচনায় বঙ্কিমচন্দ্র অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এখানে ধারাবাহিকভাবে প্রবন্ধগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে।
সমাজের বেশিরভাগ মানুষই স্বার্থের পিছনে ছুটে। বঙ্কিম ‘কে গায় ওই’ প্রবন্ধে বলেছেন যে, পুষ্প যেমন নিজের জন্য ফোটে না, তেমনই মানুষ অপরের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করে। ‘মনুষ্য ফল’ প্রবন্ধে বঙ্কিম ‘রমণীমন্ডলী’কে এ সংসারে নারিকেল বলেছেন। কুলীনরা ‘কাঁদি কাঁদি নারিকেল পাড়িয়া’ খেত বলে ব্রাহ্মণরা যে বহুবিবাহ করে সমাজকে কলুষিত করতো সেই ব্যাপারটিকে নির্র্দেশ করেছেন। ‘পতঙ্গ’ প্রবন্ধে বঙ্কিম আমাদেরকে পতঙ্গ জাতি বলেছেন। পতঙ্গ যেমন আলোতে পুড়িয়া মরে, তেমনই আমরা বংশপরমপরায় বিদেশি শাসককের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছি। ‘আমার মন’ প্রবন্ধে লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন যে, ‘আমি চিরকাল আপনার রহিলাম, পরের হইলাম না’ এই কথাটি দ্বারা মানুষের স্বার্থপরতার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। মানুষ শুধু অর্থের পিছনে ছুটে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়েছে এ কথাটি লেখক এই উক্তির মাধ্যমে বুঝিয়েছেন। ‘চন্দ্রালোকে’ প্রবন্ধে মানুষের ইতিবাচক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছেন। ‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধে মানুষকে কর্মে আত্মনিয়োগের কথা বলেছেন। বঙ্কিম বলেছেন ‘এই অসম্ভব সুন্দর জগ্য শরীরে যিনি আত্মা, তাঁহাকে ডাকি। আমিও ডাকি, তুইও ডাকিস।’ ‘স্ত্রীলোকের রুপ’ প্রবন্ধে লেখক স্ত্রীলোকের বাইরের রুপের চেয়ে তার ভেতরের রুপের কথা অর্থাৎ নারীর মানবিক গুণের প্রতি বেশি করে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। নারীর মধ্যে যে ধৈর্য্য, সহিষ্ণুতা, সহনশীলতা, প্রীতি ও ভক্তি রয়েছে সে সব কথাগুলোই এই প্রবন্ধে লেখক উল্লেখ করেছেন। বঙ্কিমের ভাষায় ‘আমি শুনিতে চাই যে, তাহারা মূর্তিমতি সহিষ্ণুতা, ভক্তি ও প্রীতি’ লাভ করেছেন।‘বড় বাজার’ প্রবন্ধে কিছু মানুষের স্বার্থপরতা ও ঠকবাজি চরিত্রের কথা বলেছেন। দোকান্দার ও খরিদ্দারের মধ্য্যে যুদ্ধ চলতে থাকে যে, কে কাকে বেশি ফাঁকি দিতে পারে। ‘সস্তা খরিদের অবিরত চেষ্টাকে মনুষ্যজীবন’ বলে প্রাবন্ধিক আখ্যায়িত করেছেন।‘আমার দুর্গোসব’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক দেবী দুর্গাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন যে দেবী দুর্গা হলো সর্বমানববের জন্য। ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে নিঃস্ব-অভাবী মানুষের সুন্দর জীবনযাপনের কথা বিড়ালের রুপকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন। ‘এ সংসারের ক্ষীর, সর, দধি, মৎস্য, মাংস, সকলই তোমরা খাইবে, আমরা কিছু পাইবনা কেন?’ এখানে বঙ্কিম গরীবের পূর্ণ অধিকারের কথা ব্যক্ত করেছেন। ‘ঢেঁকি’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক অত্যাচারী শাসককে ঢেকির রুপকে ব্যক্ত করেছেন। জমিদাররুপি ঢেকিরা ‘প্রজাদের হৃৎপিণ্ড’ কে পিষে তাদের আর্থিক ও মানসিক জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলতো, সেই বিষয়টি লেখক এ প্রবন্ধে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন।
উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনায় দেখা যায় যে, ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ রচনার মাধ্যমে লেখক সমাজের প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তি ও অবহেলিত দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে বৈষম্য / পার্থক্য ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যন্ত সুচারুভাবে। সেই সঙ্গে বঞ্চিতজনের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক সাম্যের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। উনিশ শতকের শেষার্ধে বাঙালি সমাজ-রাজনীতি, সংস্কৃতি-শিক্ষা ও সাহিত্যে যে মূল্যাবোধের অবক্ষয় ঘটেছিল সে বিষয়গুলো তিনি প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ শীর্ষক বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থে তুলে ধরেছেন। তবে বিষয়বস্তু বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য; উপস্থাপনাস্টাইল তাঁর নিজস্ব, জমিদার ও শাসকশ্রেণির মূল্যবোধের অবক্ষয় সরাসরি বলতে চাননি, বরং বক্তব্যকে রুপকের মাধ্যমে বলতে চেয়েছেন। আপাতত প্রবন্ধগুলো পাঠ করলে পাঠকের হাসি পাবে, কিন্তু এর অন্তরালে রয়েছে প্রাবন্ধিকের কান্না। বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা, আঙ্গিকগত কাঠামো, শৈলি ও রস বিচারে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা রম্যরচনার পথিকৃতের দায়িত্ব পালন করেছেন।
সালেক শিবলু এমফিল, গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।