ধ্বনিতত্ত্ব কী ? ধ্বনিতত্ত্বকে কি বিজ্ঞান বলা চলে ? ধ্বনিতত্ত্বের বিভিন্ন শাখার পরিচয় দাও । 241005

ধ্বনিতত্ত্বের
ধ্বনিতত্ত্ব কী? ধ্বনিতত্ত্বকে কি বিজ্ঞান বলা চলে ? ধ্বনিতত্ত্বের বিভিন্ন শাখার পরিচয় দাও ।

ভাষা হলো বাক্যের সমষ্টি। আর বাক্য গঠিত হয় শব্দ দিয়ে। শব্দ গঠিত হয় ধ্বনির মাধ্যমে। সেই বিবেচনায় ধ্বনিই হলো ভাষার ক্ষুদ্রতম একক। ধ্বনি,শব্দ বাক্য সবই ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয়। বাংলা ব্যাকরণের চারটি আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে অন্যতম ধ্বনিতত্ত্ব। ধ্বনিতত্ত্বের মূল আলোচ্য বিষয় ধ্বনির উচ্চারণ, ধ্বনির বিন্যাস, বাকযন্ত্রের উচ্চারণ প্রক্রিয়া, ধ্বনিদল ইত্যাদি। ধ্বনিতত্ত্ব ভাষাবিজ্ঞানের একটি শাখা যেখানে কোন নির্দিষ্ট ভাষার ধ্বনি-ব্যবস্থা আলোচিত হয়। এতে বাক ইন্দিয়ের মাধ্যমে সৃজিত ধ্বনির ভৌত উৎপাদন ও অনুধাবন নিয়ে আলোচনা করা হয়। ধ্বনিবিজ্ঞানের সাহায্যে যে কোনো ভাষার ধ্বনিসমষ্টির উচ্চারণ পরীক্ষা করে স্বতন্ত্র অর্থবোধক বিভিন্ন ধ্বনিমূলের আবিষ্কার ও সেগুলোর অবস্থান ও যাবতীয় ব্যবহারবিধির বর্ণনা করাকে ধ্বনিতত্ত্ব বলে ।

বিজ্ঞান বলতে আমরা সাধারণত বুঝি প্রকৃতির কোনো নির্দিষ্ট বিভাগ সম্বন্ধে পদ্ধতিমূলক ও সর্বাত্মক আলোচনা। সেদিক বিবেচনায় ধ্বনিতত্ত্বকে বিজ্ঞান বলা যায়। কারণ ধ্বনিবিজ্ঞান ও ধ্বনিতত্ত্বের মধ্যে ব্যাপকতর অর্থে কোনো পার্থক্য না থাকলেও সূক্ষ্মতর অর্থে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বাকপ্রত্যঙ্গ থেকে শুরু করে ধ্বনির গঠন ও শ্রুতিবিষয়ক যাবতীয় বর্ণনাই সংকীর্ণ অর্থে ধ্বনিবিজ্ঞানের বিষয়ভুক্ত, অর্থাৎ ধ্বনির গঠন, উচ্চারণঘটিত বর্ণনা, ধ্বনিরশ্রুতি এবং ধ্বনির শুদ্ধ ও অশুদ্ধ উচ্চারণ সম্পর্কে তথ্য উদ্ঘাটন করা ধ্বনিবিজ্ঞানের কাজ। বিভিন্ন পরিবেশে একটি ভাষার একটি ধ্বনির সম্ভাব্য সকল প্রকার উচ্চারণ পার্থক্য বিশ্লেষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর স্বতন্ত্র অর্থবোধক মূলধ্বনি নির্ণয় এবং তাদের লেখন পদ্ধতি আবিষ্কার ছাড়াও একটি ভাষার একটি মূলধ্বনি স্থাপন ও নির্ণয়কল্পে তার যাবতীয় বৈচিত্র বিচার করে। তাছাড়া সমগ্র ভাষায় ধ্বনির অবস্থান, বিচিত্র রকমের প্রয়োগের ফলে তার নানারকম পরিবর্তন প্রভৃতি আলোচনা ধ্বনিতত্ত্বের অন্তর্গত ।

ধ্বনিবিজ্ঞান শব্দটিতে নির্দেশ করে যে, আধুনিককালে ধ্বনিবিজ্ঞানে গবেষণা চালানো হয় সুনিয়ন্ত্রিত এবং তথ্য যাচাই করা সম্ভব হয় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এবং গবেষণার সময় ব্যবহার করা হয় ধ্বনি সংগঠন সম্পর্কিত কোনো তত্ত্ব। তাছাড়া এতে বর্ণনা করা হয়েছে পর্যবেক্ষণ সম্ভব উপাত্ত এবং উপাত্ত বর্ণনায় ব্যবহৃত হয়েছে নানা প্রণালী পদ্ধতি। তাছাড়া ধ্বনিবিজ্ঞানীরা উপাত্ত সংগ্রহ ও বর্ণনার এমন সব প্রণালী পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন যে তার যান্ত্রিকতা, নিয়ন্ত্রণ, বস্তুপ্রিয়তা ও তথ্যনিষ্ঠাকে বৈজ্ঞানিক না বলে উপায় থাকে না। তাই বিজ্ঞানের ব্যবহারিক পদ্ধতির ক্ষেত্রে ধ্বনিবিজ্ঞানে বিশেষ গবেষণাগারও ব্যবহৃত হয়। ধ্বনিবিজ্ঞানে ব্যবহৃত প্রণালি পদ্ধতি এমন সাধারণ সূত্র নির্ণয় করে, যা যে কোনো আগ্রহী যোগ্য লোক সহজেই যাচাই করতে পারবেন। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। প্রাক্তন আবিষ্কারের ভিত্তির উপরই ঘটে সমস্ত নতুন আবিষ্কার। ধ্বনিবিজ্ঞানী প্রথমে মনোযোগী হন উপাত্ত সংগ্রহে। এ উপাত্ত হচ্ছে গবেষণার বিষয়বস্তু। অতঃপর উপাত্তের বস্তুরাশিকে বিন্যস্ত করেন বিভিন্ন স্তরে। প্রথমে তিনি শনাক্ত ও শ্রেণিকরণ করেন তাৎপর্যপূর্ণ ক্ষুদ্রতম ধ্বনি একক রাশিকে , অর্থাৎ ধ্বনিমূলসমূহকে। তারপর শনাক্ত ও শ্রেণিকরণ করেন উপাত্তের অন্তর্গত রূপমূলরাশিকে। এভাবে তিনি ধাপে ধাপে সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে বিশেষ অভীষ্টে পৌঁছতে সচেষ্ট হন। এসব দিক বিবেচনায় ধ্বনিতত্ত্বকে বিজ্ঞানই বলা চলে ।
ধ্বনিতত্ত্বের প্রধান শাখা তিনটি ক. উচ্চারণীয় ধ্বনিতত্ত্ব খ. মূল ধ্বনিতত্ত্ব গ.শব্দবিজ্ঞান ধ্বনিতত্ত্ব ।

উচ্চারণীয় ধ্বনিতত্ত্ব : এই তত্ত্বে ধ্বনি গঠন ও পরিবর্তনের উপরই অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে । আমাদের মুখ ও নাক দিয়ে বাতাস ফুসফুসে প্রবেশের পর অক্সিজেন সরবরাহ করে পুনরায় স্বরযন্ত্রের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন বাপ্রত্যঙ্গ স্পর্শ করে মুখ বা নাক দিয়ে বের হয় । ফুসফুস থেকে বাতাস বের হওয়ার পর স্বরতন্ত্রীর পেছনে জমা হতে থাকে এবং স্বরতন্ত্রী খোলার পর বাতাস স্বরতন্ত্রীর ভেতর দিয়ে গলনালির পেছনে স্পর্শ করে মুখের ভেতরের বিভিন্ন অংশ স্পর্শ করে। এদিক থেকে বিচার করলে ধ্বনি গঠনে প্রত্যক্ষভাবে স্বরতন্ত্রী ও অন্যান্য বাকপ্রত্যঙ্গ বহির্মুখী বাতাসের অবরোধ সৃষ্টি করে এবং ধ্বনির প্রকৃতি নির্ধারণে সাহায্য করে । স্বরযন্ত্রের প্রকৃতি অনুসারে ধ্বনির ঘোষতা এবং মহাপ্রাণতার দিক বিচার করা হয় । অন্যদিকে, বাতাস মুখগহ্বরের মধ্যস্থিত বিভিন্ন উচ্চারণ স্থান যেভাবে স্পর্শ করে সেই অনুযায়ী সেগুলোর স্থান নির্ণীত হয়। স্বরযন্ত্র ও উচ্চারণ স্থানের পরেই উচ্চারণ পদ্ধতি অনুযায়ী ধ্বনির শ্রেণিকরণ করা হয়। উচ্চারণ পদ্ধতির ক্ষেত্রে বাতাস যেভাবে বিভিন্ন বাপ্রত্যঙ্গ স্পর্শ করার পর বাধাপ্রাপ্ত হয় ও তরঙ্গ সৃষ্টি করে, তার উপর উচ্চারণ প্রকৃতি নির্ভরশীল । সাধারণভাবে বলা যায় যে, উচ্চারণীয় ধ্বনিতত্ত্বে উপযুক্ত বৈশিষ্ট্যের সাহায্যে ধ্বনির গঠন ও উচ্চারণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়ে থাকে।
মূল ধ্বনিতত্ত্ব : এখানে ভাষায় যেভাবে ধ্বনি ব্যবহৃত হয় তার সাহায্যে মূল ধ্বনির বিচার অন্তর্ভুক্ত । এক্ষেত্রে বিভাজন ও অন্যান্য সূত্রের সাহায্যে মূল ধ্বনির প্রকৃতি বিশ্লেষিত হয়। মূল ধ্বনি শনাক্তকরণে ন্যূনতম সংখ্যাজোড়ের প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা হয় । যেমন- প, ফ, ব, ভ যে চারটি ভিন্নতর মূলধ্বনি, তা ন্যূনতম সংখ্যাজোড়ের মাধ্যমে শব্দের অর্থগত দিকের সাহায্যে নির্দেশ করা যায় । পাতা, ফাতা, বাতা, ভাতা এই চারটি ন্যূনতম সংখ্যাজোড়ের উদাহরণে চারটি ক্ষেত্রেই শব্দের শেষাংশ সমশ্রেণির অর্থাৎ আতা এ অংশটি দ্বারা গঠিত এবং শুধু প্রথম চারটি ধ্বনিই যে ভিন্ন তা প্রমাণ করা যায় অর্থসঙ্গতির মানের দিক থেকে ।

শব্দবিজ্ঞান ধ্বনিতত্ত্ব : শব্দবিজ্ঞান ধ্বনিতত্ত্বে শারীরিক বৈশিষ্ট্য এবং মূল ধ্বনি শ্রব্যগত দিকে কানের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে সেই দিকগুলো সাধারণভাবে অস্তর্ভুক্ত। ফুসফুস থেকে বাতাস বের হওয়ার পর স্বরযন্ত্র ও মুখগহ্বরে বিভিন্ন বাপ্রত্যঙ্গের সংস্পর্শে ধ্বনিতরঙ্গের সৃষ্টি হয়, তার বিশ্লেষণ শব্দবিজ্ঞান, ধ্বনিতত্ত্বের প্রধান বিচার্য দিক । ধ্বনিতরঙ্গ সরল বা জটিল হতে পারে এবং বিভিন্ন ধ্বনি গঠনের সময় ধ্বনিতরঙ্গের প্রকৃতি তা নির্ধারণ করে থাকে ।
সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক,বাংলা বিভাগ, জাতীয়  বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

About সালেক শিবলু

বিএ অনার্স, এমএ (প্রথম শ্রেণি) এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

View all posts by সালেক শিবলু