চৈতন্যজীবনী সাহিত্য সম্পর্কে একটি নিবন্ধ রচনা কর।

চৈতন্যজীবনী সাহিত্য

চৈতন্যজীবনী সাহিত্য সম্পর্কে একটি নিবন্ধ রচনা কর।

চৈতন্যজীবনী সাহিত্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারা। এটি একটি মৌলিক সাহিত্যধারা। কোন মহান পুরুষের জীবনকে অবলম্বন করে যে সাহিত্যগড়ে উঠে, তাকে জীবনী সাহিত্য বলে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এ রকম অনেক ব্যক্তির জীবনকে নিয়ে সাহিত্য রচিত হয়েছে। তবে সাহিত্যে শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনকে নিয়ে এই ধারার প্রথম রচিত হয়। চৈতন্যদেবের জীবনকে নিয়ে যে সাহিত্য রচিত হয়েছে তাকেই জীবনী সাহিত্য বলে। তিনি একজন সাধক পুরুষ ছিলেন। পৃথিবীতে মানবধর্ম প্রেম প্রচার করে আজীবন কাটিয়েছেন। একটি বাক্যও তিনি নিজের হাতে রচনা করেন নি। তবুও তিনি বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। নি¤েœ চৈতন্যজীবনী সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

সংক্ষিপ্ত জীবনকথা : শ্রীচৈতন্যদেব ১৪৮৬ সালে নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম জগন্নাথ মিশ্র, মাতার নাম শচীদেবী। চৈতন্যের বাল্য নাম ছিল নিমাই, দেহবর্ণের জন্য নাম রাখা হয় গোরা বা গৌরাঙ্গ। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল বিশ্মভর। চৈতন্যদেব বাল্যকালে চঞ্চলপ্রকৃতির বালক ছিলেন। বড় ভাই সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। তাই পিতামাতা সব সময় চৈতন্যদেবকে নিয়ে চিন্তায় থাকতেন। যাতে চৈতন্য সন্ন্যাসী না হয় সেই কারণে তাকে পড়াশোনার সুয়োগ দেওয়া হয় নি। কিন্তু তিনি নিজের আগ্রহে ধর্ম বিষয়ে প্রচুর জ্ঞান লাভ করেন। পিতামাতা অল্প বয়সেই চৈতন্যদেবকে লক্ষèীদেবীর সঙ্গে বিয়ে দেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সর্পদংশনে প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যু হয়। চৈতন্যদেব আর বিয়ে করতে চায় নি। ছেলে যাতে সংসারি হয় সেই কারণে মাতা তাকে আবার বিয়ে দেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম বিষ্ণুপ্রিয়া। ২৩ বছর বয়সে পিতার মৃত্যু হলে পিতৃপি- দিতে গিয়ে এক বৈষ্ণসাধকের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ২৪ বছর বয়সে তিনি কাটোয়ায় গিয়ে কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ করে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য সংক্ষেপে শ্রীচৈতন্য নামে খ্যাত হোন। দীর্ঘদিন তিনি ধর্মের বাণী প্রচার করেছেন এবং অবশেষে ১৫৩৩ সালে পুরীতে মৃতুবরণ করেন। এইমহান সাধক পুরুষকে নিয়ে সংস্কৃত ও বাংলা উভয় ভাষায় জীবনীসাহিত্য রচিত হয়েছে।

বাংলা ভাষায় রচিত জীবনীসাহিত্যের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরুপ :

১.বৃন্দাবনদাসের শ্রীচৈতন্যভাগবত : বাংলা ভাষার শ্রীচৈতন্যের প্রথম জীবনীকাব্য বৃন্দাবনদাসের শ্রীচৈত্যের ভাগবত।কাব্যটির রচনাকাল ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দ।কবি তাঁর গুরু নিত্যানন্দের কাছ থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করে কাব্যটি লিখেছেন।কবি চৈতন্য ও নিত্যানন্দকে কৃষ্ণ ও বলরামের অবতার জ্ঞান করেছেন।চৈতন্যের বাল্য ও কিশোরলীলা বাস্তবতা ও সরলতা সহকারে বর্ণনা করেছেন।কারণ, কোমল, কঠোর ও পৌরুষদীপ্ত চৈতন্যকে কবি এঁকেছেন।চৈতন্যের মানব ও ভাবমর্তি সমানভাবে কাব্য বিধৃত।সমকালীন সমাজের বিবিধ দিক পুঙখানুপুঙখরুপে চিএিত।মানবীয় রস এ কাব্যের স্বতনÍ মর্যাদা দিয়েছে।তত্ত্বজিজ্ঞাসু, দার্শনিক ও সাধারন মানুষ সবাই তাঁর কাব্য থেকে বিশেষ রস আস¦াদন করতে পারে।

২.লোচনদাসেন চৈতন্যমঙ্গল : এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ চৈতন্যজীবনীগ্রন্থ। কবি তাঁর গুরু নরহরি সরকারের আদেশে ১৫৫০-৫৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কাব্যটি রচনা করেন। কাব্যটি সাধারণ বিশ্বাসপ্রবণ বৈষ্ণবভক্তদের জন্য রচিত। এবং এর রচনাধারা অনেকাংশে মঙ্গলকাব্যের অনুরুপ। কাব্যচৈতন্যজীবনের আদিরসাত্মক লীলা বর্ণনায় ঐতিহাসিকতা ক্ষুন্ন হয়েছে। তবে কবির কবিত্বশক্তির পরিচয় এ কাব্যে রয়েছে।

৩.জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল : ১৫৬০ সালের দিকে এ কাব্যটি রচিত হয়। গতানুগতিকভাবে কাব্যটি জনসাধারণের জন্য রচিত বলে এতে ঐতিহাসিকতা ক্ষুন্ন হয়েছে। কাব্যটির রচনারীতি মঙ্গলকাব্য ও পৌরাণিক ধরনের। কাব্যটিতে তেমন কোন কাব্যগুণ নেই। তাছাড়া এ গ্রন্থ বৈষ্ণবসমাজে সমাদর পায় নি। স্বাধীন রচনা হিসেবে কাব্যটির আলাদা একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে।

৪.কৃষ্ণদাস কবিরাজের শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত : চৈতন্যজীবনীকারদের মধ্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজের কাব্য নানা দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্বের আসন পেয়েছে। তার কাব্যের নাম শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত। কাব্যটি কবির পা-িত্যে, মনীষায়, দার্শনিকতা ও রসমাধুর্যে অদ্বিতীয়। কবি এ কাব্যে চৈতন্যজীবনাদর্শ ভক্তিবাদ, দ্বৈতবাদী, দার্শনিক চিন্তায় বাঙালি মনীষার এক উজ্জ্বলতম স্বারক চরিত্র অঙ্কন করেছেন। কবি বৃদ্ধকালে ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে কাব্যটি রচনা করেন। এর পূর্বে তিনি চৈতন্যঅনুচরদের কাছ থেকে বৈষ্ণবসাহিত্যে বুৎপত্তি লাভ করেন। বৈষ্ণব সমাজে এ কাব্যটি উপনিষদের মর্যাদা পেয়েছে। এ গ্রন্থে মনন, দর্শন, তত্ত্বজ্ঞান এবং রসবোধের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে।

৫.গোবিন্দ দাসের কড়চা : এ গ্রন্থটি নিয়ে অনেক রকম বিতর্ক রয়েছে। চৈতন্যদেবের দাক্ষিণাত্য ও পশ্চিমভারত ভ্রমণ অবলম্বনে কাব্যটি রচিত হয়েছে। গোবিন্দ দাস ছিলেন চৈতন্যদেবের ভৃত্য। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে জয়গোপাল গোস্বামী এ কাব্যটি প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থের প্রামাণিকতা সম্পর্কে সন্দেহ আছে।

৬.চূড়ামণিদাসের গৌরাঙ্গ বিজয় : ড. সুকুমারসেন এ কাব্যটি প্রকাশ করেছেন। কাব্যটির অপর নাম ভুবনমঙ্গল। কাব্যটি খ-িত হিসেবে পাওয়া গিয়েছে। এতে চৈতন্যজীবনের তথ্যগত ভুলভ্রান্তি আছে। সম্ভবত শ্রুত-স্মৃতি থেকে এ কাব্যটি রচিত হয়ে থাকতে পারে বলে কোন কোন গবেষক মনে করেন। বৈষ্ণব সমাজে এ কাব্যটি গৃহীত হয়নি।

চৈতন্যজীবনী সাহিত্যের গুরুত্ব : বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাব অপরিসীম। এই প্রথম মানুষের জীবনকে গুরুত্ব দিয়ে সাহিত্য রচিত হলো। মঙ্গলকাব্যে ভূমি ছেড়ে লেখকেরা বাস্তব পৃথিবীতে আসলেন এবং সাহিত্যে মানবজীবনকে প্রাধান্য দিলেন। দেবীর জায়গায় মানবজীবন প্রতিষ্ঠিত হলো। এই জীবনী সাহিত্য রচনার মাধ্যমে সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে নতুন বিষয় সাহিত্যে সংযোজিত হয়েছে। চৈতন্যদেব সমগ্র মানবজীবনে প্রভাব বিস্তার করেছেন এবং সমাজের বৃহৎ অংশ তাঁকে অনুসরণ করেছে। বৈষ্ণব ধর্মের ব্যাপক সম্প্রসারণের মাধ্যমে তিনি এ দেশের হিন্দু সমাজে নবচেতনার সঞ্চার করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি সমাজে মানুষের মধ্যে বিশেষ ধরনের বিপ্লব ঘটালেন। তাই নানা কারণে চৈতন্যজীবনী সাহিত্য গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুর ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *