কাহিনিকাব্য হিসেবে নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যের সার্থকতা আলোচনা কর।

নকশী কাঁথা
কাহিনিকাব্য হিসেবে নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যের সার্থকতা আলোচনা কর।

জসীম উদ্দীন আমাদের নিকট পল্লিকবি হিসেবে বেশি পরিচিত। ‘রাখালী’ কাব্যগ্রন্থ দিয়ে তিনি বাংলা কাব্যের অঙ্গনে প্রবেশ করেন। তারপর পর্যায়ক্রমে রচনা করেছেন বেশ কিছু কাব্য ও কাহিনিকাব্য। তাঁর কবিতায় গ্রামবাংলার চিত্র ও গ্রামীণ মানুষের জীবনযাপন অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। বাংলা কাব্যে ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ একটি অসাধারণ কাহিনিকাব্য। এই কাব্যটি ১৯২৯ সালে প্রকাশ হয়। নি¤েœ কাহিনিকাব্য হিসেবে ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কাব্যের সার্থকতা আলোচনা করা হলো-

‘নকশী কাঁথার মাঠ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ কাহিনিকাব্য। কাব্যটি চৌদ্দপর্বে বিভক্ত, প্রতিটি পর্বে বাংলার চিরচেনা পল্লির দৃশ্য উপস্থাপিত হয়েছে। প্রথম পর্বের বিষয় : একটি মাঠ দিয়ে বিভক্ত করা পাশাপাশি দুটি গ্রাম। এই মাঠই এককালে নকশী কাঁথার মাঠ নামে পরিচিত লাভ করে। সংক্ষিপ্ত কাহিনি এই : বাঁশ কাটতে গিয়ে রুপাই এবং সাজুর পরিচয় হয়, তাদের মন দেয়া নেওয়া হয়, অতপর বিয়ের মাধ্যমে দু’জনের সংসার শুরু হয়। গ্রাম্য দ্বন্দ্বে জড়িয়ে হঠাৎ তাদের জীবনে নেমে আসে দুর্গতি। দুই গ্রামের মানুষের মধ্যে বিবাদ লাগে। রুপাই এই বিবাদে নিজের গ্রামের পক্ষে নেতৃত্ব দেয়। অনেক মানুষ এ বিবাদে আহত হয়। থানায় মামলা হয়, রুপাইকে এই মামলার আসামি করা হয়। তাই গ্রেফতার এড়ানোর জন্য রুপাই গ্রাম থেকে পালিয়ে বেড়ায়। আর এ ভাবে সাজুর সাজানো সুন্দর সংসার ভেঙ্গে যায়, সাজুর সুন্দর স্বপ্ন ভেঙ্গে যায় রুপাই বিরহে। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, কিন্তু রুপাই আর ফেরে না। রুপার চিন্তায় সাজুর দেহ আস্তে আস্তে দূর্বল হয়ে যায়। সব দুঃখ-কষ্টকে বরণ করে সাজু রুপার জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকে। সাজু আবার নকশী কাঁথা নিয়ে বসে। কাঁথার উপরে এক পাশে সাজুর বর, আর এক পাশে গ্রামের রাখালের একটি ছবি অঙ্কন করে। মনের মতো করে সাজু এ ছবি আঁকে, বার বার সে ছবি দেখে আর চোখের জলে বুক ভাসিয়ে দেয়। জসীম উদ্দীন ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কাব্যে পতি প্রেমের এ এক অপূর্ব চিত্র তুলে ধরেছেন। সাজু তার মাকে কবরের উপর এই নকশী কাঁথাটি বিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করে। এরপর সাজু রুপাই বিরহে আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। রুপাই বিরহে সাজুর জীবনের করুণ সমাপ্তি ঘটে। আর অপরদিকে রুপাই অনেকদিন পর গ্রামে ফিরে আসে। সাজুর বিরহে কাঁদতে কাঁদতে সাজুর কবরের উপর রুপাই মৃত্যুবরণ করে। এভাবে গ্রামের দুটি প্রেমিকজুটির জীবনের করুণ অবসান ঘটে । পল্লি বাংলার সহজ-সরল প্রকৃতি ও বিরহ-মিলনের চিরন্তন গাঁথা এ কাব্যে শিল্পরুপে উপস্থাপিত হয়েছে । সাজুর কবরের উপর নকশী কাঁথাটি সাজু ও রুপার প্রেমের মহিমাকে মহিমান্বিত করে তুলেছে। এই সাথে এই কাব্যটি ট্ট্যাজেডির বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে, সাজু প্রেমের অতুলনীয় নিদর্শন গ্রামবাসীকে দেখিয়ে এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেয়।

জসীম উদ্দীন কাহিনি নির্বাচন করেছেন গ্রাম থেকে। গ্রাম্য ছেলে ও মেয়ের প্রেমকে ভিত্তি করে এ কাহিনি গড়ে উঠেছে। রুপাইি ও সাজু এ কাহিনিকাব্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র। প্রেমকে কেন্দ্র করে এ কাহিনি আস্তে আস্তে পরিণতি লাভ করেছে। নর-নারীর চারিত্রিক মহিমা উদঘাটনে, জীবনের বাস্তব রুপায়নে, কাহিনির গ্রন্থন প্রচেষ্টায় উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি পরিবেশ ও প্রকৃতি অনুযায়ী শব্দ ব্যবহার করেছেন। ফলে চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। নানা রঙের সুতোয় বোনা নকশী কাঁথার মতো করে জসীম উদ্দীন নানা প্রকৃতি ও বর্ণের সমন্বয়ে এ কাহিনিকাব্যের রুপদান করেছেন। কাব্যটি নানামুখী ফুল দ্বারা রচিত একটি মালিকার ন্যায়। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনেশচন্দ্রসেন, কালিদাস থেকে শুরু করে সৈয়দ আলী আহসান, শামসুর রাহমান পর্যন্ত প্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিকগণ ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কাব্যের প্রশংসা করেছেন। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল্যায়ন ‘জসীম উদ্দীনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পন্ন নতুন ধরনের। প্রকৃত কবির হৃদয় এই লেখকের আছে।’

একটি গ্রন্থের সফলতা কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। এ বিষয়গুলো হলো লেখকের প্রকাশভঙ্গি, উপস্থাপনাশৈলি, কাহিনির বুনন, ভাষাদক্ষতা, শব্দ চয়ন, উপমা, রুপক ইত্যাদির সফল প্রয়োগ। জসীম উদ্দীন ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কাব্যে উপমার সফল ও শৈল্পিক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। উপমার একটি দৃষ্টান্ত এখানে দেয়া যেতে পারে। সাজু গ্রামের মেয়ে। গ্রামের মেয়েরা শাড়ি পড়তে পছন্দ করে। সাজু শাড়ি পড়েছে, এই শাড়ির রঙ লাল ছিল। কবি শাড়ির রঙের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-‘লালা মোরগের পাখার মত উড়ে তাহার শাড়ী’। এভাবে অলঙকারের শৈল্পিক প্রয়োগে ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ বাংলা কাহিনিকাব্য একটি সফল কাব্য হিসেবে সংযুক্ত হয়েছে।

উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, কবি জসীম উদদীন ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কাব্যে দুটি গ্রামের একটি ছেলে ও একটি মেয়ের প্রেমকাহিনিকে উপস্থাপন করেছেন। চরিত্রদুটি পূর্ণাঙ্গরুপে বিকশিত হয়েছে। এ কাব্যে উপন্যাসের কিছুটা বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। আপাতত প্রেম সফল হলেও সব শেষে নেমে আসে বিয়োগান্ত পরিণতি। উপস্থাপনারীতি অভিনব, শব্দ নির্বাচন ও প্রয়োগে তাঁর বিশেষত্ব রয়েছে। তিনি বিশিষ্ট শিল্পীর ন্যায় সমকালীন সমাজ ও সমাজ বাস্তবতার দিকে লক্ষ্য রেখে আরবি ও ফারসি শব্দের সফল ব্যবহার এ কাব্যে দেখিয়েছেন। সব কিছু মিলিয়ে সার্বিক বিবেচনায় কাহিনিকাব্য হিসেবে ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ একটি সফল কাব্য। বাংলা সাহিত্যে এ রকম কাহিনি কাব্য অতুলনীয়।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *