বিষাদসিন্ধু উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা কর।

বিষাদসিন্ধু

বিষাদসিন্ধু উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা কর। (সর্বত্র বিষাদের ছায়া)

মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৬-১৯১২) আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য  মুসলিম লেখক। তাঁর সাহিত্যকর্মের ভাণ্ডার অত্যন্ত সমৃদ্ধ।‘ বিষাদসিন্ধু’ তাঁর কালজয়ী উপন্যাস। কারবালার প্রান্তরের বিষাদময় কাহিনি অবলম্বনে এ গ্রন্থটি রচিত। নামকরণের মাধ্যমে লেখক তাঁর সৃষ্টিকর্মের ভাবব্যঞ্জনা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেন। তাই নামকরণ সাহিত্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রসঙ্গক্রমে এখানে ‘বিষাদসিন্ধু’ উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা করা হলো-

মীর মশাররফ হোসেন ‘বিষাদসিন্ধু’ উপন্যাসের কাহিনিকে মোট তিনটি পর্বে ভাগ করেছেন। এ গুলো হলো মহররম পর্ব (১৮৮৫), উদ্ধার পর্ব (১৮৮৭), ও এজিদ বধ পর্ব (১৮৯০)। মহররম পর্বে উপক্রমণিকাসহ ২৭টি , উদ্ধার পর্বে ৩০টি এবং এজিদ বধ পর্বে ৫টি সহ মোট ৬২টি অধ্যায় আছে। এ অধ্যায়গুলোকে প্রবাহ নাম দেয়া আছে।

উপন্যাসের কাহিনি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, উপন্যাসের প্রতিটি পর্বে, প্রতিটি অধ্যায়, প্রতিটি প্রবাহে, প্রতিটি চরিত্রে বিষাদের কালো ছায়া পড়েছে। এ বিষাদময় ঘটনাকে লেখক তাঁর শৈল্পিক নিপুণতায় জীবন্ত ও প্রাণবন্ত করে তুলেছেন। এ বিষাদ ও করুণ কাহিনির বর্ণনা পাঠককে আচ্ছাদিত করে। বিষয়টি আরো বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।

উপন্যাসের প্রধান প্রধান চরিত্র হলো মুয়াবিয়া, এজিদ, হাসান, হোসেন, জয়নব, জাএদা, সীমার, মারওয়ান, মোহাম্মদ হানিফাসহ অসংখ্য চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে এ উপন্যাসে। ছোট-বড় সব চরিত্রেই কম-বেশি বিষাদের কালো ছায়া পড়েছে। এজিদ এ উপন্যাসের প্রধান ও নায়ক চরিত্র। জয়নবের রূপে মুগ্ধতা, পরিণামে ব্যর্থতা, তা থেকে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে একে একে অসংখ্য মানুষের জীবননাশ ‘বিষাদসিন্ধু’ উপন্যাসের কাহিনিকে বেদনাবিদুর করে তুলেছে।

উপন্যাসের কাহিনিসূত্রে জানা যায় জয়নবের স্বামী আব্দুল জব্বার তথাকথিত রাজকন্যা সালেহার লোভে নিষ্পাপ স্ত্রী জয়নবকে তালাক প্রদান করে। এ প্রসঙ্গে লেখক ‘ বিষাদসিন্ধু’ কথাটি প্রথম ব্যহার করেন। লেখকের ভাষায় : জয়নাবের আশাতরী বিষাদসিন্ধুতে ডুবিয়া গেল’। এজিদ, আক্বাস ও ইমাম হাসান জয়নবের নিকট বিয়ের প্রস্তাব এক সাথেই প্রেরণ করে। জয়নব ইমাম হাসানের বিয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করে অন্য দুজনকে প্রত্যাখান করে। এতে এজিদ হাসানের প্রতি ক্ষিপ্ত ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। হাসানের তিন স্ত্রী; হাসনেবানু, জাএদা ও জয়নব। এজিদ কৌশলে মায়মুনা নামক কুটনীর মাধ্যমে জাএদার মধ্যে সপতœীবাদ জাগ্রত করে তোলে। এজিদ মায়মুনাকে পুরষ্কার আর জাএদাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণের আশ্বাস প্রদান করে। ফলে জাএদা বিষ প্রয়োগে প্রথম দুবার ব্যর্থ হলেও তৃতীয়বার সফল হয়। এভাবে ইমাম হাসানের জীবনের করুন অবসান ঘটে। এর পরের ঘটনা আরো বিষাদময়। মায়মুনার কপালে পুরষ্কারের পরিবর্তে ঘটে পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে নির্মম মৃত্যু, আর জাএদার পাটরাণীর পরিবর্তে রাজ দরবারে সবার সামনে তলোয়ারের কোপে দ্বিখণ্ডিত হয়। এভাবে উপন্যাসের প্রতিটি ঘটনা বিষাদের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

জয়নব এজিদের জন্যই তার প্রথম স্বামী আব্বাসকে হারিয়েছে। আবার দ্বিতীয় স্বামী হাসানকেও হারাল। জয়নবকে পাওয়ার জন্যই এজিদ ভয়ঙ্কর যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সব কিছুর মূলে জয়নবকে না পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও সেই সাথে বিষাদের কালো ছায়া জড়িয়ে আছে।

ইমাম হাসানের কারবালার প্রা›তরে মৃত্যুর ঘটনা এ উপন্যাসের সবচেয়ে করুণ ও বেদনাদায়ক ঘটনা। নিষ্ঠুর সীমার খঞ্জর হাতে হোসেনের বুকের উপর বসে কারবালার প্রান্তরে যে ভাবে হোসেনের মাথায় খঞ্জর চালিয়েছে তা যে কোন পাঠককে বিষাদময় করে তোলে। এর পর ঘটে আরো বিষাদময় ঘটনা; সীমার খণ্ডিত মস্তক বর্শায় বিদ্ধ করে দ্রুতবেগে চলতে থাকে, তখন আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে রব ওঠে ‘হায় হোসেন! হায় হোসেন!’ পথে সন্ধ্যা হলে সীমার আজর নামক এক ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় নেয়্ সেখানে আরও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। আজর ইমাম হোসেনের মস্তক রক্ষার জন্য তার পুত্রের মস্তক কেটে এনে দেয়। কিন্তু এতে শেষ রক্ষা হয় নি। পাষাণ সীমার আজরকে নির্মমভাবে হত্যা করে হোসেনের মস্তক নিয়ে পুনরায় দামেস্কের পথে যাত্রা করে। এ সমস্ত বিষাদময় কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে মীর মশাররফ হোসেন যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, তা সত্যিই অতুলনীয়।
এজিদ হোসেনের পরিবারকে বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। সংবাদ পেয়ে মোহাম্মদ হানিফা জয়নার আবেদীনসহ পরিবারকে উদ্ধার করতে ছুটে আসে। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। মোহাম্মদ হানিফা এ যুদ্ধে অনেক লোক হত্যা করে, মোহাম্ম হানিফা এজিদকে পিছন দিক থেকে ধাওয়া করে; এজিদ পালাতে থাকে; সবশেষে একটি কুটিরে প্রবেশ করে। হানিফা তাকে হত্যা করতে না পেরে ক্রোধে যাকে পায় তাকেই হত্যা করতে থাকে। তখন ঈশ্বর তাকে প্রস্তর নির্মিত একটি দেয়ালে বন্দি করে রাখে। এ সব ঘটনা সত্যি সত্যিই মানবমনকে বিষাদে ভরিয়ে তোলে।

উপর্যুক্ত আলোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, বিষাদসিন্ধুর মূল কাহিনির সাথে ছোট-বড় অনেক কাহিনি সংযুক্ত হয়ে ঘটনা¯্রােত একটি সফল পরিণতির দিকে গিয়েছে। কাহিনির শুরু বিষাদের ছায়া দিয়ে, আবার সমাপ্ত হয়েছে বিষাদ দিয়ে। এ বিষাদকে লেখক সিন্ধু নদীর সাথে তুলনা করেছেন। তাই সব কিছু মিলিয়ে এ উপন্যাসের নামকরণ ‘বিষাদসিন্ধু’ সফল ও সার্থক হয়েছে।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

* বিষাদসিন্ধু উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা কর।  প্রশ্নটি সর্বত্র বিষাদের ছায়া এইকই উত্তর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *